হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি


 প্রথমেই ভেবে দেখুন, কারা শেখ মুজিবকে "হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে মুজিববাদকে সমর্থন দিয়ে ফ্যাসিবাদের বয়ানকে শক্তিশালী করেছে বছরের পর বছর ধরে।
কেবল আওয়ামী লীগ ও তার পেটোয়া লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরাই? না!!!

বরং, বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী জাহেলিয়াতের উচ্ছিষ্ট খেয়ে ভুঁড়ি বানিয়ে বসা ব্যুরোক্রেটস, যারা আসিফ নজরুলের সমর্থনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ডিপস্টেইটকে জিম্মি করার কারণে জুলাই আন্দোলন সফল হতে পারেনি বলে স্বয়ং হাসনাত আব্দুল্লাহ স্বীকার করেছে এবং প্রতিবিপ্লবীদের অভ্যুত্থান ঘটেছে, তাদের কারণে মুজিববাদ এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে অভ্যূত্থান পরবর্তী সময়েও।

ইসলাম ও মুসলমানদের আধিপত্য রুখে দিতে জঙ্গিবাদের জুজু তৈরী করে মার্কিন "ওয়ার অন টেরোর" এর সাথে সমর্থন জানিয়ে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গং মুজিববাদ এর বয়ান তৈরী করে জনগণের উপর আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের নীতিগত বৈধতা তৈরী করেছে।

শাহবাগী বাম বাটপার এবং কালচারাল কুলাঙ্গার গোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি-বিপক্ষ শক্তি ন্যারেটিভ তৈরী করে বাঙালিয়ানার বয়ানে কলকাতার সাংস্কৃতিক জমিদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় মুজিববাদকে নব্য এক ধর্মে রূপান্তর করেছে।

মুজিববাদকে পুঁজি করে, এই উম্মাহর উপর আওয়ামী জাহিলিয়াতকে নিজ "অখন্ড ভারত" প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শক্তিশালী করতে প্রত্যক্ষ রূপে সহযোগিতা করেছে মূলত ভারত। ১৯৪৭ এর পর থেকেই অবিভক্ত পাকিস্তানকে বিভক্ত করে বাংলাদেশকে সিকিম স্টাইলে নিজের আরেকটি প্রদেশ হিসেবে অধিগ্রহণ করতে শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণের লুপ তৈরী করতে প্রথমে পিতা এবং পরবর্তীতে কন্যাকে নিজ জাতির উপর জুলুমের স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে সরাসরি ট্রেইনিং দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত।

অর্থাৎ, বস্তুবাদী কিছু চেতনার খাম্বাকে ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে মুজিববাদের শিরকী আদর্শের পতন ঘটানো মানেই আবরার ফাহাদের শাহাদাতের বদলা নেয়া নয়। বরং, দিল্লীর বাবরি মসজিদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে কালিমার ঝান্ডা গেড়ে দেওয়ার মাধ্যমেই মুজিববাদের আদর্শকে চূড়ান্ত রূপে দাফন করা সম্ভব, আবরার ফাহাদের শাহাদাতের প্রকৃত বদলা নেওয়া সম্ভব। নতুবা মুজিববাদ নতুন নতুন শিরোনামে এই জাতির ঘাড়ে চেপে বসবে। এই যেমন মাস খানেক আগে এক সেমিনারে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করেছে তারেক রহমান।

রাজনীতি মানে শুধু জনসমর্থন তৈরী করা না, নির্বাচন না, ভোটাভুটি না। বরং, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা থাকে, আদর্শ থাকে। নিজেদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় সৃষ্ট জুলুম-অত্যাচারকে নীতিগত বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রতিটি দলের থাকে নিজস্ব কিছু ন্যারেটিভ। হাসিনা তার স্বৈরতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়ার জন্য মুজিববাদকে ব্যবহার করেছে। জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তি হিসেবে বিভক্ত করেছে। ঠিক একইভাবে হাসিনার পতনের পর নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারে, জনসমর্থন তৈরীতে, চাঁদাবাজিকে নীতিগত বৈধতা দিতে জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বিএনপি, মুজিববাদের পরিবর্তে জিয়াবাদকে পুঁজি করে আরেক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে দ্রুত নির্বাচনের জন্য ওয়াশিংটনের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র সংস্কারের পূর্বেই ইউনূস প্রশাসনের উপর চাপ দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনের নির্দেশনা মাফিক রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার রাজপথের ফুট সোলজার হচ্ছে সমন্বয়করা। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বেলা যত গড়িয়েছে, সমন্বয়কদের রাজু ভাস্কর্য কেন্দ্রিক একাধিক ব্যর্থ কর্মসূচি, মিডিয়াপাড়ায় বিভিন্ন টকশোতে ইউনূস নেতৃত্বাধীন এনজিওবাদী প্রশাসনের রাজনৈতিক অনুশীলনের অনভিজ্ঞতার ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা, আসিফ নজরুলদের নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লবী মহলের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হওয়া ওয়াশিংটনকে এই রাষ্ট্রের রাজনীতিতে নিজের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে তত পিছিয়ে দিচ্ছিল।

শুভেন্দু অধিকারী, ময়ুখ রঞ্জনদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত ভৃত্য ড. ইউনুসকে সংবিধান বিরোধী শাসন কায়েম করে তালেবানি, মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায় দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। মুজিববাদের চেতনার কিবলাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার ব্যাপারটা একদিকে ভারত এবং আওয়ামী লীগের ড. ইউনূসের ব্যাপারে বিষোদগারকে যেমন নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে, তেমনি করে রিভার্স সাইকোলজি অনুযায়ী ফ্যাসিবাদ নির্মূলে রাষ্ট্র সংস্কারের নামে ইউনূস এবং সমন্বয়কদের হাত ধরে ওয়াশিংটনের প্রভাব বিস্তারে নৈতিক বৈধতা তৈরী করবে।

অপরদিকে, বিএনপি-জামায়াতকে দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর নাম দিয়ে ওয়াশিংটনের কাঙ্খিত সংস্কার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হতে আরো উদ্বুদ্ধ করবে। ডা. শফিকুল ইসলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের চেতনার মন্দির গুড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটিকে কেন "উস্কানিমূলক কর্মকান্ডে সায় দেওয়া" হিসেবে দেখছেন, তা আশা করি স্পষ্ট। সাথে করে জামায়াতে ইসলামীর ইমেজ ক্লিন রাখার ব্যাপারটাও জড়িত। কারণ, ভারত এবং আওয়ামী লীগ এই ঘটনার পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে সব সময় জামায়াত-শিবিরকেই চিহ্নিত করবে।

আরেকটা জরুরি বিষয় হচ্ছে, ওয়াশিংটনের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে ইউনূস প্রশাসনকে ক্রমেই চাপ দিয়ে চলা বিএনপি-জামায়াতকে একটা ক্লিয়ার মেসেজ পাঠানোর জন্য জুলাই আন্দোলনের পর রাজপথ ছেড়ে ঝিমুতে থাকা শান্তিকামী বিপ্লবী ছাত্র জনতাকে ব্যবহার করা গেছে মুজিববাদের খাম্বা গুঁড়িয়ে দিয়ে।

ইতোমধ্যে, সেক্যুলার মহল থেকে কালিমার পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা, তাকবীর দেওয়াকে কেন্দ্র করে মাঠ পর্যায়ে নিজেদের উপস্থিতি তৈরী করে নিজেদের সামাজিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক এই ঘটনার সাক্ষী হতে আসা ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিকে ফ্রেইম করা হচ্ছে। ভারতের মিডিয়াগুলোতে পর্যন্ত মাওলানা আতাউর রহমান বিক্রমপুরীদের নাম চলে আসছে।

১৯৭১ এ স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তাগুত মুজিবের মৃত্যুর পর এতটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে  ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। পুরো ব্যাপারটা কি এতটা অকস্মাৎ ঘটিয়ে ফেলা হয়েছে? জুলাই আন্দোলনে তাগুত হাসিনার পতনে মার্কিন ভৃত্য ইউনূসের ক্ষমতায়ন সৃষ্টি হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী বিষয় ছিল। ঠিক তেমনি, আওয়ামী জাহিলিয়াতের পতনের একটি অবশ্যম্ভাবী ধাপ হচ্ছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে চেতনার খাম্বার পতন।

মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখুন, জুলাই আন্দোলনে কি "হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি'মাল ওয়াকিল" আয়াত আওরিয়ে, শাহাদাতের স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাবিহীন আবেগী মুসলিম উম্মাহকে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটনের নির্দেশনায় বহুত্ববাদের মত নব্য কুফরী মতবাদ চাপিয়ে দিয়ে ইসলামপন্থিদের ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কি এক সেক্যুলার তাগুতের পতন হয়ে আরেক ক্রুসেডার তাগুতের অধিষ্ঠান ঘটানো হয়নি?

ঠিক তেমনি করে, উম্মাহর আবেগকে কাজে লাগিয়ে কালিমার পতাকা নিয়ে, আল্লাহু আকবার তাকবীরে মুজিববাদের কবর রচনায় দলে দলে ছুটে আসা ইসলামপন্থীদেরকে কি এখন ফ্রেইম করা হচ্ছে না? বারবার উম্মাহর ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের মাইনাস করার ব্যাপারে পিনাকী গং কখনো মুখ খুলেছে? দিল্লির ডবল এজেন্টের মুখে ধানমন্ডি ৩২ এর পরিত্যক্ত জায়গায় মসজিদ নির্মাণের আলাপ শুনে আবেগী উম্মাহ পিনাকীকে ঈমানদার জ্ঞানী করা শুরু করেছে। ওয়াকফ করা না হলে, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতে মসজিদ বানানো শরীয়তে আদৌ জায়েজ আছে? চেতনার মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের বয়ান আদতে কাদের হাতে ইসলামপন্থীদের চূড়ান্ত কোণঠাসা করার শক্তিশালী ন্যারেটিভ তুলে দেবে দেবে, ভেবে দেখেছেন?

রাষ্ট্রীয় যেকোনো অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী যতটা দক্ষ, অন্যান্য বাহিনী কি ততটাই দক্ষ? দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যত বাড়বে, সেনাবাহিনীকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশের ভূখণ্ডগত অখন্ডতা রক্ষায় মিলিটারি ট্রেইনিং থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ততটাই অভ্যন্তরীণ জন নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকতে হবে এবং এই ব্যাপারটা সেনাবাহিনীকে আল্টিমেটলি বিপ্লবী জনতার বিপরীতে অবস্থান নিতে বাধ্য করবে। তাবেদার শ্রেণীর কিছু উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ব্যতিরেকে ভারতের সাথে যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ঢালাওভাবে সেনাবাহিনীকে বারবার শত্রু হিসেবে ফ্রেইম করার এজেন্ডা আসলে কাদের স্বার্থ চরিতার্থ করছে, মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবুন।

সেক্যুলার-ডেমোক্রেটদের তৈরী করা পপুলিজমের বয়ান গলাধঃকরণ করে সামাজিক শক্তি অর্জনে যেকোনো কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কোনো প্রকার মেরুকরণ তৈরী না করে স্রোতের সাথে ভেসে গিয়ে ইসলামপন্থীরা কি আদৌ নিজেদের নেতৃত্ব সংকট দূর করতে পারবে?

দাবাতে চাল একবার দেওয়ার পর পিছু হতে যাওয়ার যেমন সুযোগ নেই, রাজনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে কেবল ঝোঁকের বশে কোনো পলিটিকাল মুভমেন্টে অংশ নিয়ে এর পরিণতি কি হবে, সেটা ক্যালকুলেট না করতে চাওয়ার অভ্যাস আমাদেরকে বারবার সেক্যুলার রাজনীতির বলীর পাঠা বানায়।

নিজেদেরকে সেক্যুলার রাজনীতির সস্তা টিস্যুপেপার না বানিয়ে ইসলামপন্থীদের কৌশলগত ফায়দা হাসিল করার লক্ষ্যে সেক্যুলারদের মধ্যকার অন্তর্কোন্দলে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি অংশ না নেওয়ার ব্যাপারটা নিষ্ক্রিয়তার মানহাজ ধারণ করা নয়। জোয়ারের স্রোতে গা ভাসানোর আগে ভাটার টানে তলিয়ে যাওয়ায় আশঙ্কা মাথায় থাকলে সংকট এবং সংকট মোকাবেলায় পলিসি নির্ধারণে সহজ হয়। কিন্তু সেলিব্রিটিজম এবং পপুলিজমের চোরাবালিতে আটকে যাওয়া এই উম্মাহ সংকটকে সংকট হিসেবে চিহ্নিত করার পূর্বেই বিকল্প কর্মসূচি খোঁজে বলেই, উম্মাহর আদর্শিক এবং মানহাজগত আত্মসংশোধনের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই।

উম্মাহর অভিভাবক হতে চাইলে যে কোনো পলিটিকাল অ্যাকটিভিজমে জড়ানোর পূর্বে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি গভীর ভাবে পর্যালোচনা করে নিজেদের নেতৃত্ব সৃষ্টিতে  নিজেদের স্বকীয় ন্যারেটিভ তৈরী করতে পারা জরুরি ইসলামপন্থীদের জন্য। নতুবা ইসলামপন্থীরা সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা অর্জনের নামে অজ্ঞাতসারে এই সেক্যুলার কাঠামোকেই শক্তিশালী করবে। তাই, মেরুকরণ জরুরি। এটা ইসলামপন্থীদের বিপ্লবের জন্য, শরীয়াহর জন্য ময়দানকে আবাদ করবে।

লিখেছেনঃ আবু উসামা

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন