বিবাহ সম্পর্কে অবগত নয় এমন মানুষ হয়তো দুনিয়াতে খুব কমই আছে। মুসলমান-অমুসলমান এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষ প্রায় সকলের জীবনেই একদিন বিবাহের আবির্ভাব ঘটে। বিবাহের মাধ্যমেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবকে আবাদ রাখবেন। আর ইসলামী শরীআতে তো বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। কিন্তু ইবাদতের সেই পদ্ধতিটি আজ এতই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ধনী-গরীব, ধার্মিক অধার্মিক প্রায় সকলেই এ বিষয়ে বিপদগ্রস্থ।
অথচ ইসলাম বিবাহ শাদীকে সহজতম একটি বিষয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহবায়ে কেরাম নিজেদের জীবনে এটি অত্যন্ত সহজভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
ইদানীং একটা বিষয় অনলাইনে বার বার চোখে পড়তেছে।
আর তা হল ‘বিয়ের ক্ষেত্রে নারী নিজেই পুরুষকে প্রস্তাব দেওয়া সুন্নত’? এতে অনেকে বিভ্রান্তও হচ্ছে। আবার অনেকে এসব কথায় উৎসাহিত হয়ে অনলাইনের মতো ফিতনাহযুক্ত প্লাটফর্মে ছেলেদেরকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে বসতেছে! এতে আরো ফিতনা বাড়তেছে। তাই এ বিষয়টা ওযাহাত করা জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে।
ইসলামী শরীয়তে একজন নারীর জন্য কোনো পুরুষকে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া সুন্নত নয়। সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়ীন, তাবে- তাবেয়ীন সহ আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মুজতাহিদ আলিম এটাকে সুন্নত হিসাবে সাব্যস্ত করেনি।
কিন্তু কিছু ভাই-বোনেরা তাদের বই-পুস্তকে এবং নিজেদের টাইমলাইনে এটাকে সুন্নত বলে খুব প্রচার করতেছে। যা খুবই দুঃখজনক। হাদিসে কোনো কিছু থাকলেই সেটা সুন্নত হয়ে যায় না। একটা বিষয় সুন্নত হওয়ার জন্য শরীয়তে কতিপয় শর্তাবলী রয়েছে। সকল সুন্নাহ হাদিস, কিন্তু সকল হাদিস সুন্নাহ নয়। কিছু ভাইয়েরা এ সহজ বিষয়টা বুঝতে পারে না। ফলে একটার সাথে আরেকটার জগাখিচুড়ি লাগিয়ে দেয়। হাদিসে থাকলেই যদি একটা বিষয় সুন্নত হয়ে যায়, তাহলে তো দাড়িয়ে পেশাব করাও বড় সুন্নত বলে বিবেচিত হবে। একজন পুরুষের ১১ টা বিবাহ করাও সুন্নত হিসাবে সাব্যস্ত হবে।
তাই একজন নারীর জন্য নিজেকে কোনো পুরুষের কাছে উপস্থাপন করা (অর্থাৎ বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া), এক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান হচ্ছে, ফিতনার আশংকা না থাকলে প্রস্তাব দিতে পারবে। যেমনটি হযরত আনাস রাযি. এর হাদিস থেকে বুঝা যায়।
‘সাবেত আল-বুনানী রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
আমি আনাস রাযি.এর কাছে ছিলাম। তাঁর কাছে তাঁর মেয়ে ছিলেন। এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে নিজেকে (বিয়ের জন্য) পেশ করে বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কি আপনার প্রয়োজন আছে? আনাস রাযি. এর মেয়ে বললেন: ছি! ছি! তাঁর লজ্জাবোধ কতই কম! তখন আনাস রাযি. বললেন: সে মহিলা তোমার চেয়ে উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আগ্রহবশত তিনি তাঁর কাছে নিজেকে পেশ করেছেন।”[সহিহ বুখারী-৪৮২৮]
ইমাম ইবনে বাত্তাল রহ. বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শরহু সহীহিল বুখারীতে’ লিখেন, ‘ইমাম মুহাল্লাব রহ. বলেন, কোন পুরুষের দ্বীনদারি, মর্যাদা, ইলম, কিংবা বিশেষ কোন দ্বীনি বৈশিষ্ট্যে বিমোহিত হয়ে কোন নারীর জন্য নিজেকে সে পুরুষের কাছে উপস্থাপন করা ও পরিচয় তুলে ধরা জায়েয আছে; এতে দোষ ও কলঙ্কের কিছু নেই। [শরহু সহীহিল বুখারীতে ৭/২২৭]
ইমাম বদরুদ্দিন আইনি আল হানাফি রহ. বুখারী শরীফের
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘উমদাতুল কারী শরহে সহিহুল বুখারীতে’ এমনটাই লিখেছেন, ‘অর্থাৎ আনাস রাযি. এর উক্তি ‘সে মহিলা তোমার চেয়ে উত্তম’। এটা থেকে প্রমাণিত হয় একজন মহিলা নেককার ব্যক্তিকে প্রস্তাব দিতে পারবে। এটা জায়েয আছে। তার কিছুক্ষণ পরে তিনি লিখেন ‘তবে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে এমন করলে সেটা হবে নিকৃষ্টতম কাজ।’ [উমদাতুল কারী শরহে সহিহুল বুখারী ২০/১১৩ আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা (৩০/৫০) ]
তবে বৈধ থাকা সত্বেও এভাবে প্রস্তাব দেওয়া অনুত্তম। ক্ষেত্র বিশেষ ফিতনার আশংকায় নিষিদ্ধও বটে। বরং প্রস্তাব দেওয়াবে পিতা-ভাই অথবা অন্য কোনো মাহরামের মাধ্যমে। কেননা উত্তম হচ্ছে একজন নারী যদি কোনো পুরুষের দ্বীনদারি এবং চরিত্রের ব্যাপারে আগ্রহবোধ করে তাহলে অভিভাবক দিয়ে ওই পুরুষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো। যেমনটা নবী শোআইব আ. করেছিলেন।
قَالَتْ إِحْدَاهُمَا يَا أَبَتِ اسْتَأْجِرْهُ إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الأَمِينُ. القصص/26
‘নারীদ্বয়ের একজন বলল, আব্বাজী! আপনি একে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোন কাজ দিন। আপনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কারও থেকে কাজ নিতে চাইলে সেজন্য এমন ব্যক্তিই উত্তম, যে শক্তিশালী হবে এবং আমানতদারও।’ সুরা কাসাস-২৬
বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন,
قال القرطبي : قوله تعالى : ( قَالَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أُنْكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَى أَنْ تَأْجُرَنِي ثَمَانِيَ حِجَجٍ ) القصص/27 فيه عرض الولي ابنته على الرجل ،
وهذه سنَّة قائمة عرض صالح مدين ابنته على صالح بني إسرائيل ، وعرض عمر بن الخطاب ابنته حفصة على أبي بكر وعثمان ، وعرضت الموهوبة نفسها على النبي صلى الله عليه وسلم ، فمن الحَسن عرض الرجل وليته ، والمرأة نفسها على الرجل الصالح اقتداء بالسلف الصالح ، قال ابن عمر لما تأيمت حفصة قال عمر لعثمان : " إِنْ شِئْتَ أَنْكَحْتُكَ حَفْصَةَ بِنْتَ عُمَرَ " ، انفرد بإخراجه البخاري (4005) تفسير القرطبي " ( 13 / 271 ) .
‘আল্লাহ তা’য়ালার বানী (তার পিতা বলল, আমি আমার এই দুই মেয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই, এই শর্তে যে তুমি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আট বছর আমার এখানে কাজ করবে। কাসাস-২৭) এতে রয়েছে অভিভাবক তার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দেবে পুরুষের কাছে। এটাই প্রতিষ্ঠিত সুন্নত। যেমন হযরত উমর রাযি. তার কন্যা হাফসা রাযি. এর ব্যাপারে আবু বকর এবং উসমান রাযি. কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।’
[তাফসীরে কুরতুবি ১৩/২৭১]
তবে এ বিষয়েও সতর্ক করা জরুরি যে, বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা যে নির্দিষ্ট পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, এর কারণ হল ‘হারাম উপকরণের’ কারণে। যেমন একে অপরের সাথে কথা বলা, এক সাথে আড্ডা দেওয়া। আর বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার
কারণে এ বিষয়টা আরো সহজে পরিণত হয়েছে। কখনও এমন হয় যে, যাকে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে তার অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। ফলে নারীর থেকে এ প্রস্তাবকে সে তার কামনা চরিতার্থ করার সুবর্ণ সুযোগ মনে করে। এবং এটাকে কাজে লাগিয়ে হারাম রিলেশন থেকে নিয়ে সব রকমের অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়। তাই এভাবে প্রস্তাব দেওয়া থেকে নারীকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। নয়তো নিজের ভূলের কারণে সর্বস্বও হারানো লাগতে পারে।
অনেক সময় অনলাইনে একজনের প্রোফাইল দেখে তাকে দ্বীনদার মনে হয়, অতচ বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারে। অনেক সময় বিধর্মী ছেলেরা ধার্মিক সেজে মুসলিম মেয়েদেরকে নিজের দিকে আকর্ষিত করে। ফলে এভাবে প্রস্তাব দেওয়া, হতে পারে নিজেকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো। এসব অবস্থায় একজন নারীর জন্য কোনো ছেলেকে প্রস্তাব দেওয়া বৈধ নয়।
শরয়ী মূলনীতি হল,
قاعدة سد الذرائع: فإن مثل هذه الطريقة لا تأمن المرأة على نفسها مما قد يوقعها في المصائب والمتاعب.
১.অবৈধতার পথ বন্ধ করা। কারণ এভাবে প্রস্তাব দেওয়া বর্তমান সময়ে একজন নারীর জন্য নিরাপদ নয়।
ثانيا- قاعدة: ( الضرر يزال)، وحديث النبي صلى الله عليه وسلم:” لا ضرر ولا ضرار“.
২. ক্ষতি দুর করা হবে। নবী করিম সা. এর বানী, নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া যেমন যাবে না তেমনি অপরকে ক্ষতিগ্রস্থ করাও যাবে না।
মুফতি Khairul Islam 03/5/2023
নজরে সানী মুফতি Affan Bin Sharfuddin হাফি.
হানাফী ফিকহ-Hanafi Fiqh
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন