বার্মার আগুন বাংলায়

 


৪৭-এ দেশ ভাগের পর এই প্রথম মিয়ানমার স্মরণকালের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্ত পার করছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়াটা প্রমাণ করে মিয়ানমারের ভেতরগত পরিস্থিতি কতটা ভীতিকর।


মিয়ানমার খন্ড খন্ড হলে বাংলাদেশের জন্য তা বড়ো ধরণের বিপদের কারণ হবে। এমনকি এটা ভারতের জন্যও বিপদ ডেকে আনবে।


(১) বাংলাদেশের ভেতরে থাকা উপজাতি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো মানসিকভাবে উৎসাহ পাবে।


(২) মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে সেই আগুন বাংলাদেশেও প্রবেশ করবে। কারণ, বাংলাদেশের উপজাতিদের ৯৫% বাংলাদেশকে নিজেদের রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বাস করে না। তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। এই মতবাদ নতুন কোনো উদ্ভাবন না। বাংলাদেশের পেছনের ইতিহাসে এর কালো অধ্যায় আছে।


(৩) মিয়ানমার সীমান্তের ওপারের সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের উপজাতি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোকে দেদারসে সহায়তা দেবে। ফলে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার চিত্রটা বর্তমান মিয়ানমারের অনুরূপ হবে। ভারতের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটবে। মিয়ানমার হবে বাংলাদেশ ও ভারতের উপজাতি সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোর সেইফ হ্যাভেন। যেহেতু বিচ্ছিন্ন হওয়া রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের অফিসিয়াল কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যবহার করে এসবের কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিকার বাংলাদেশ করতে পারবে না।


(৪) এই তিন দেশের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো তখন সম্মিলিতভাবে নির্দিষ্ট একটি কমান্ডিংয়ের অধীনে এক হয়ে কাজ করবে; যাদের মূল লক্ষ্য হবে যত বেশি সম্ভব রাজ্য বা অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের ভেতরে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের ঘটনা দেখেছেন। এই দলটা পুনরায় সক্রিয় হবে। 'যা ঘটেছে যা ঘটছে যা ঘটবে' বইটাতে দেখিয়েছিলাম ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বড়ো চারটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মূলত একই। ৪৭-এ দেশ ভাগের সময় তারা তিন দেশের সীমানায় বিভক্ত হয়ে যায়। সেখানে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। ভিষণ দূর্গম ও গভীর অরণ্য। সুতরাং ওরা বেশ ভালোভাবেই নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।


“যা ঘটেছে যা ঘটছে যা ঘটবে” বই থেকে কিছু অংশ।


"আরও যেমন : মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (MNF), চিন ন্যাশনাল আর্মি (CNA), কুকি ন্যাশনাল আর্মি (KNA), জোমি রেভোলুশনারি আর্মি (ZRA) নামে স্বাধীনতাকামী চারটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আছে, যারা কিনা ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, ত্রিপুরা, আসাম প্রদেশ এবং মিয়ানমারের রাখাইন, চিন, সাগায়িং প্রদেশ; বাংলাদেশের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার অঞ্চলগুলো নিয়ে ‘জোগাম স্টেট’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এই ‘জোগাম স্টেট’ আয়তনে বাংলাদেশের থেকেও বড়ো। এরা মূলত ‘জো জনগোষ্ঠী’। ভারতের মিজোরাম প্রদেশের মিজো জনগোষ্ঠী এবং মিয়ানমারের চিন প্রদেশের কুকি-চিন জনগোষ্ঠী মূলত একই জনগোষ্ঠী। এদের বংশধারা ও সংস্কৃতি একই। ’৪৭-এ দেশ ভাগের সময় এই জনগোষ্ঠীটিকে বাধ্যতামূলকভাবে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে এক অংশকে ভারতের অধীনে যেতে হয়, আরেক অংশ যায় মিয়ানমারের অধীনে। এই চারটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর লক্ষ্য হলো ‘জো জনগোষ্ঠী’-কে একত্র করা।


কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী শুধু নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত। কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী সীমান্তের দুই পাশের দুই দেশের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত। কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজের দেশ ও অন্য দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত। পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয়, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। আবার চীনের সেনাবাহিনী ভারত ও মিয়ানমারের কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয়, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। আবার বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মিয়ানমারের দু-একটা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে।


অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের লাখ লাখ বর্গকিলোমিটারের পাহাড়ি অঞ্চলগুলো অনিরাপদ। খুবই নাজুক একটা পরিস্থিতিতে আছে। যুদ্ধের আগুন একদিক থেকে লাগলে তা দাউদাউ করে এই তিনটা দেশের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।"

__➋

(৫) একটু ঝুঁকি নিয়ে কথাটা বলতেই হচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভালো সম্পর্ক আছে। বলতে গেলে বিডি আর্মি আরাকান আর্মিকে আশ্রয় দেয়। আরাকান আর্মি মিয়ানমারে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। কারো মুখ থেকে শুনে বা উড়ো কথার ওপর ভিত্তি করে বলছি না। বান্দরবানের দূর্গম এলাকায় একাধিকবার ট্যুরে গিয়ে নিজের চোখেই দেখেছি এসব। (আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাদা একটা সিরিজ লিখব ইন শা আল্লাহ।)। তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিডি আর্মির এই কাজকে আমাদের সমর্থন করতে হবে। বস্তুত নিজেদের স্বার্থে এতটুকু কৌশল অবলম্বন করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। তাছাড়া প্রতিপক্ষ ভারত ও মিয়ানমার যখন যুগের পর যুগ এই কৌশল অবলম্বন করে চলেছে, তখন পালটা আঘাত হিসেবে বিডি আর্মির এই একই কৌশল অবলম্বন দোষের কিছু না। 'সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' বলতে বিজ্ঞানে একটা টার্ম আছে। বরং এটা দেখার বিষয় আরাকান আর্মি আরাকান রাজ্য স্বাধীন ঘোষণা করতে পারলে বিডি আর্মির অবদানের ব্যাপারে কৃতজ্ঞ আচরণ করে কি না। অকৃতজ্ঞ হবে এটা নিশ্চিত। কারণ, আরাকান আর্মির সিংহভাগ ফান্ডিং আসে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে।


(৬) এখানে মূল কলকাঠি নাড়ছে আমেরিকা ও ইউরোপ। দেখুন পশ্চিমারা কতটা দূরদর্শী। দশকের পর দশক এনজিওগুলোর আড়ালে দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে নিজেদের পক্ষে সশস্ত্র দল তৈরি করেছে। মূলত পশ্চিমারা ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সকল উপজাতি সন্ত্রাসীগোষ্ঠিগুলোর অর্থের মূল যোগান দাতা। কৌশল, আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি আদায়, বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির সবটাই পশ্চিমাদের ইশারায় ঘটে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে এমন একটা ভান করবে–যেন মনে হবে ওখানে কিছুই ঘটছে না। খেয়াল করে দেখুন বর্তমানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রায় নীরব। গ্রামি এওয়ার্ড নিয়ে একের পর এক নিউজ করে যাচ্ছে। টেইলর সুইফট কয়টা এওয়ার্ড পেল সেটা এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম।


আমেরিকা এই অঞ্চলে এই পথেই প্রবেশ করবে। এটা ছাড়া আমেরিকার হাতে কার্যকরী কোনো পথ খোলা নেই। এটা এক ঢিলে তিন পাখি শিকারের মতো। মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ; তিনটি দেশকে একটি কৌশলের দ্বারা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে। বিডি নির্বাচন নিয়ে নীরব থেকে আমেরিকা অন্য দিক দিয়ে চাল চেলেছে।


(৭) চীন এখানে কিছুই করতে পারবে না। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করবে না। কারণ, মিয়ানমারের বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলো জান্তা সেনাবাহিনীর তুলনায় বেশি ডেডিকেটেড ও মোরাললী হাইলি মোটিভেটেড। তাই চীন যদি জান্তা সেনাবাহিনীর পক্ষে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় আর কোনোভাবে পাশার দান উলটে যায়, তখন চীনের সীমান্ত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। তাই চীনও একপ্রকারের মৌন সম্মতি দিয়ে যাচ্ছে এই বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোকে। তবে বেশ কয়েকবার চীনের মধ্যস্থতায় জান্তা সরকারের সাথে বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর বৈঠক হয়েছে। অস্ত্র বিরতি হয়েছে। কিছুদিন পর সব বিফলে গিয়েছে। বর্তমানে চলমান সংঘাতও দুই পক্ষের চুক্তি ভঙ্গ করেই হচ্ছে। কিছুদিন আগেও চীনের দূতিয়ালিতে অস্ত্র বিরতি চুক্তি হয়েছিল। সুতরাং বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকেও আশানুরূপ কোনো সাপোর্ট পাবে না। এক রোহিঙ্গা ইস্যুই তো ঝুলে আছে আজকে প্রায় সাতটি বছর।


(৮) মিয়ানমার খন্ড খন্ড হলে সর্বপ্রথম ওরা বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলাকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ নেবে। তখন ভারত এখানে সুবিধা আদায় করতে আসবে। নিজেদের সেভেন সিস্টার্সের ঝুঁকি থাকা সত্বেও ভারত এমনটা করবে কারণ–বাংলাদেশে যুদ্ধের দামামা বাজলে ভারতের ভিষণ লাভ। এতে করে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা এক ধাপ এগিয়ে যাবে। 'পরে কি হবে দেখা যাবে' নীতি অবলম্বন করে ভারত বাংলাদেশের উপজাতি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেবে।


(৯) বাংলাদেশের সেক্যুলার পাড়ার ৯০% তখন পশ্চিমের নির্দেশনায় উপজাতিদের পক্ষাবলম্বন করবে। মায়াকান্না জুড়ে দেবে। সভা-সেমিনার করে বিডি সেনাবাহিনীর ওপর এথনিক ক্লিনসিংয়ের অপবাদ চাপাবে। বাঙালী জাতি তখন নিজ চোখে গ্রামীণ ব্যাংকের ইউনূস আর ফজলে হাসান আবেদের ব্র্যাকের আসল চেহারা দেখবে। সাথে থাকবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম : ‘বিবিসি’, ‘রয়টার্স’, ‘গার্ডিয়ান’, ‘সিএনএন’, ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘আল-জাজিরা’; আন্তর্জাতিক এনজিও : হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট; জাতিসংঘ, জাতিসংঘের অধীনস্থ সংস্থা : ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ইউএনএইচসিআর, ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ। পশ্চিমাদের অনুগ্রহে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া প্রফেসররা তো আছেই। বহুমুখী এত চাপ সামলে নেওয়া বাংলাদেশের মতো চুনোপুঁটির পক্ষে অসম্ভব। যদি না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা করে রাখেন।


লিখেছেনঃ কারিম শাওন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন