ভারত ২০০৮ সালে মিয়ানমারের রাখাইন তথা আরাকান রাজ্যের সিতওয়েতে একটি সমুদ্র বন্দর তৈরির প্রজেক্ট শুরু করে। প্রজেক্টের নাম 'কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট'।
প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চিকেন নেক নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোরের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প পথে সেভেন সিস্টার্সে যাতায়াত করা।
রুট ম্যাপটা হচ্ছে, পণ্যবাহী বা সামারিক সরঞ্জামবাহী জাহাজঃ
- কলকাতা সমুদ্র বন্দর থেকে সিতওয়ে সমুদ্র বন্দর আসবে (৫৩৯ কি.মি.)।
- এরপর কালাদান নদী পথে মিয়ানমারের চিন স্টেটের পালেতোয়াতে পৌঁছাবে (১৫৮ কি.মি.)।
- পালেতোয়া থেকে পাহাড়ি সড়ক পথে যরিনপুই যাবে (৬২ কি.মি.)।
- এরপর যরিনপুই থেকে ভারতের মিজোরামে প্রবেশ করবে (১১০ কি.মি.)।
- চিকেন নেক তথা শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে এই পথের দূরত্ব ১৮৮০ কি.মি.।
- কালাদান প্রজেক্ট সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে সেই দূরত্ব অর্ধেক কমে গিয়ে ৯৫০ কি.মি. হবে। অর্থাৎ অর্ধেক।
ওদিকে সিকিম তো দখল করা রাজ্য। তাই সিকিমবাসীর পুরনো ক্ষতের ক্ষোভ আছে। নেপালও ভারতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। সেভেন সিস্টার্সের স্বাধীনতাকামীরা তো আছেই। যদি কোনো কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পালটে গিয়ে ক্ষমতা সেনাবাহিনী কিংবা ভারতবিরোধী কারো হাতে যায়, তখন শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশ করা ভারতের জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে। চীন ভারতকে এই চিকেন নেকেই চেপে ধরবে। ভারতের সবচেয়ে বড়ো দূর্বলতা এই সেভেন সিস্টার্স। তাই ভারতের জন্য বিকল্প পথ লাগবেই। এই কালাদান প্রজেক্টই হচ্ছে সেই বিকল্প পথ। বুঝতেই পারছেন ভারতের কাছে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট!
প্রায় ১৫ বছর পর ২০২৩ সালে প্রজেক্টের ৯০% কাজ শেষ। সিতওয়ে সমুদ্র বন্দর, কালাদান নদী খনন, পালেতোয়া জেটি। সমুদ্র বন্দর উদ্বোধনও হয়েছিল গত বছর। বাকি ছিল কেবল পালেতোয়া থেকে যরিনপুই যাওয়ার ৬২ কি.মি. সড়ক পথের কাজ। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে মিয়ানমারের হুন্টা বাহিনীর সাথে স্বাধীনতাকামীদের তুমুল লড়াই শুরু হয়।
জানুয়ারির ১৪ তারিখে আরাকান আর্মি পালেতোয়া বিজয় করার ঘোষণা দেয়। কালাদান নদী পথের যাত্রা শেষ হয়ে এই পালেতোয়া জেটি থেকেই সড়ক পথের যাত্রা শুরু। বুঝতেই পারছেন খেলার মোড় কোনদিকে ঘুরে গেল। ভারতের গোটা প্রজেক্ট মাঠে মারা খাওয়ার উপক্রম। তাই ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে মোদির ইন্টেলিজেন্স এডভাইজর অজিত দোভাল একটি বিশেষ সামরিক বিমানে চড়ে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশে আসে। শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক হয়।
ভাবতে পারেন–এখানে বাংলাদেশের ভূমিকা কি?
আছে। আছে। বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। পালেতোয়ার বেশ কাছেই বাংলাদেশের মাতামুহুরি রিজার্ভ ফরেস্ট। এই সীমান্ত এলাকা আরাকান আর্মির সেইফ জোন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের স্বার্থে আরাকান আর্মিকে আশ্রয় দিয়েছে। কারণ, ওদিকে দিয়ে ভারত বাংলাদেশের তিন পার্বত্য অঞ্চলের জেএসএস, ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরাকান আর্মিকে যেন কোনো প্রকার সহায়তা না করা হয়, মূলত এ জন্যই অজিত দোভালে বাংলাদেশ সফর।
আসলে চীন এতদিন প্রজেক্টের বেশিরভাগ বাস্তবায়ন করতে দিয়েছে। শেষ সময়ে এসে পালেতোয়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা আরাকান আর্মিকে দিয়ে দখল করিয়ে পুরো প্রজেক্টকে মাঝখান থেকে দ্বিখণ্ডিত করে দিল চীন। সিতওয়ে সমুদ্র বন্দর ভারতের দরকার নেই। দরকার ছিল সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশ। এ জন্য পুরো ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পুরোটাই ভারত খরচ করেছে। এখন এই কালাদান নদী পথ ও সিতওয়ে সমুদ্র বন্দর আরাকান আর্মি ব্যবহার করবে। সিতওয়ের অধিকাংশ জায়গাও আরাকান আর্মির দখলে। একসময় এই পুরো প্রজেক্টের ফায়দা লুটবে চীন।
ভারত একটা বিরাট বাঁশ খেল। এটা ভারতের জন্য বিশাল একটা কূটনৈতিক পরাজয়৷ ভারত এই অঞ্চলে বাঁশ খেলে সেটা আমেরিকার জন্যও ক্ষতি। মূলত মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যুতে ভারত ও আমেরিকা শোচনীয়ভাবে চীনের কাছে পরাজিত হয়েছে।
— কারিম শাওন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন