এক গায়কের গানে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ভুলে গেছে কাঠফাঁটা রোদের তাপ!

 

এক গায়কের গানে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ভুলে গেছে কাঠফাটা রোদের তাপ। ভুলে গেছে ট্রাফিক-জ্যাম। ভুলে গেছে ধর্ম-নীতি-নৈতিকতা। এক মেয়ে প্রিয় গায়ককে জড়িয়ে ধরতে পেরে আবেগে কেঁদে দিয়েছে। ভুলে গেছে গায়ক হলেও তার সামনে যে আছে, সে একজন রক্তমাংসের যুবক। তাকে মেয়েটা 'টিভিতে' দেখলেও ছেলেটা কিন্তু মেয়েটাকে চেনে না। কোথাকার কোন 'ফ্যান' পাগলের মত গায়ে সেটে যাচ্ছে,
হাতে চুমা দিচ্ছে, দৃশ্যটা ভাবতেও গা গুলায়। কোনো মেয়ে ব্যক্তিগতভাবে অপরিচিত অচেনা একটা ছেলেকে প্রথম দেখায় জড়িয়ে ধরতে পারে? চুমু খেতে পারে? তাও আবার অপর পক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা 'কনসেন্ট'-এর তোয়াক্কা না করেই? মেয়েরা কি এতটাও নির্লজ্জ হয়? জানা ছিল না। 

খালি এই মেয়েটাকে দোষ দিয়ে কী লাভ! বাকি ৯৯% মেয়েও সুযোগ পেলে একই কাজ করত। তারা মনে মনে আফসোস করছে কেন এই মেয়েটার বদলে সে যেতে পারল না। রাস্তার কোনো অচেনা ছেলে যদি একটা মেয়েকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে, শিস বাজায়, হঠাৎ এসে চুমু খায়, তাকে আমরা বলি 'বখাটে'। এখন মনে হচ্ছে, মেয়েরাও কম বখাটে নয়! কোনো গায়ক বা নায়ককে সামনে পেলে মেয়েদেরও নিজেদেরকে সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। 

 

প্রিয় গায়কের দেখা পেতে মানুষ আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে, ট্রাফিকের জ্বালা সয়ে, পত্রিকার কাগজ দিয়ে বাতাস করতে করতে এই প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমেও কনসার্টে হাজির। সময়ের আগেই চলে এসেছে সবাই। এক একজন ঘেমে নেয়ে একাকার। টিকেট হয়ত আগেই কাটা আছে, এরপরেও সরাসরি ঢোকার উপায় নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই আসল জায়গায় পৌঁছানো যাবে। তবু কিন্তু কারো মুখে কোনো অভিযোগ নেই। ভালোবাসার মানুষটাকে এক নজর দেখা, একবার নিজের কানে তার গান শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব।

 

 

কনসার্টের খবর পেয়ে মাইক্রোফোন হাতে প্রশ্ন করতে বেরিয়েছে সাংবাদিকরা। পেটের দায়ে তাদেরও কিছু রমরমে নিউজ করতে হয়। আপু, এত গরমে কেমন লাগছে? আপুদের উত্তর, অনেক ভালো লাগছে। আমি অনেক এক্সাইটেড। অমুক গায়ককে দেখব ভেবে গরম ফীল-ই হচ্ছে না। 


মেয়েগুলো কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলে নি। কাউকে ভালোবাসলে গরম-ঠাণ্ডা কোনো বিষয়? ছোটবেলা থেকে আপনি যাকে ভালোবেসেছেন, যার গান শুনে বড় হয়েছেন, যার গানের সুরে আপনার শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে, মন মাতাল হয়ে যায়, তাকে দেখার সুযোগ তো আর চাট্টিখানি কথা না! 

 

 

সত্যি বলতে, এই কথাগুলোই কিন্তু আমিও ভাবি। যখন আমরা কেউ গরমের মধ্যেও বোরকা পরি, নিকাব পরি, তখন আশেপাশে থেকে অনেক কটু কথাই শুনতে হয়৷ কেউ কেউ বাঁকা নজরে তাকায়। এই গরমে প্যাকেট সেজে আছি, দেখতে সঙের মতো লাগছে, ফ্যাশনের কিছুই জানিনা, অশিক্ষিত গাঁইয়া খ্যাত, এমন আরো কত কথা। কেউ অবাক হয়, এত গরমের মাঝে কীভাবে হিজাব করা সম্ভব? কেউ আবার ভদ্রভাবে বলে যে, গরমে তাদের মাথাব্যথা করে বা অন্য কোনো ধরণের মেডিকেল কন্ডিশন আছে, তাই তারা হিজাব করতে পারে না। এই ধরণের অনেক মেডিকেল কন্ডিশনঅলা আপুরাও কিন্তু মনের টানে কনসার্টে চলে গেছে৷ একদিনের জন্য গরমের কষ্টটা নাহয় সয়ে নেবে, নাহয় আর কেমন 'ফ্যান'। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মাথায় করে সে ছুট লাগায় ভালোবাসার গায়ককে একনজর দেখবে আশায়!

 


আমাকে কেউ প্রশ্ন করলে আমি সবাইকেই বলি, হিজাব পরাটা আসলে গরম-ঠাণ্ডার ব্যাপার না। এমন দেখেছি যারা বাবা-মায়ের ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হিজাব করেছে, বাসার বাইরে গিয়ে বোরকা পরে নিয়েছে, কারণ বাসায় জানলে হিজাব করতে দিবে না। যুদ্ধকবলিত স্থানে মহিলারা ঘরের ভেতরেও বোরকা পরে আছে! গরমের ভেতর কষ্ট হচ্ছে তবুও! কারণ তারা মৃত্যুর সময় বেপর্দায় থাকতে চায় না। এ হলো ভালোবাসা৷ আপনি যদি দাবি করেন যে আপনি আল্লাহকে ভালোবাসেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসেন, তাহলে সেই ভালোবাসার শক্তিতেই আপনি হিজাব করতে পারবেন৷ গরম পড়ুক, ঠাণ্ডা পড়ুক, মাথাব্যথা হোক, চুল ভেজা হোক, পরীক্ষার হল থেকে বের করে দিক, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাক, কোনোকিছুই আপনাকে হিজাব করা থেকে আটকাতে পারবে না। দুনিয়ার কারো শক্তি নেই আশেক ব্যক্তিকে আটকানোর। মানুষের জন্য মানুষ যখন আশেক হয়, তখনই তাকে আটকানো যায় না! আর রবের জন্য যে হৃদয় উতলা হয়েছে, তাকে বাধা দেয়ার সাধ্য কার আছে? 

 

 

প্রিয় গায়কের কনসার্টেও কিছুই বাধা হতে পারেনি। মেয়েরা যতটা সম্ভব সাজগোজ করে, খোলামেলা পোশাক পরে, নিজেকে আকর্ষণীয় করে নিয়েছে। একবার যদি গায়কের সুনজর পড়ে তাও বা কম কী! প্রবাসের কোনো একটা কনসার্টে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড দুজনে কনসার্ট দেখতে গেছে। গায়ক হঠাৎ সেই মেয়েটাকে ইশারায় ডেকেছে। মেয়েটা তো খুশিতে লাফাতে লাফাতে স্টেইজে চলে গেছে। বয়ফ্রেন্ড তার গার্লফ্রেন্ডের কাণ্ডকীর্তি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এর মধ্যে স্টেইজের পর্দায় দেখা গেল, গায়ক লোকটা নাচতে নাচতে খুবই বাজেভাবে মেয়েটার কাছাকাছি চলে এসেছে। মেয়েটার তবুও কোনো বিকার নেই। সে প্রিয় গায়কের সাথে তাল মিলিয়ে নেচেই চলেছে। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গীও তাকে থামাতে পারছে না। এই নোংরামি সহ্য করতে না পেরে বয়ফ্রেন্ড সেখান থেকে চলে যায়। পরের ঘটনা বলতে পারব না। তবে দেশ আমাদের যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে মনে হয় কোনো নায়ক বা গায়ক ডাক দিলে আমাদের মেয়েরাও সব করতে রাজি। 

 

 

প্রিয় আপুরা,

তোমরা যারা এক গায়কের জন্য নিজের লাজলজ্জা সমস্তই বিসর্জন দিয়েছ, স্যরি টু সে, তাদের কাছে কিন্তু তোমার দুই পয়সারও ভ্যালু নেই। জ্বী হ্যাঁ, ওদের জন্য গান বা অভিনয় শুধুই পেশা। ক্যারিয়ার আর টাকার জন্য ওরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। দিন নেই রাত নেই, দেশেবিদেশে ছুটছে। খেয়াল করলে দেখবে, অনেক সেলিব্রিটির নিজস্ব সোশাল মিডিয়া একাউন্টও নেই। হয়ত কোনো ফ্যানবেইজ বা মার্কেটিং টিম তাদের হয়ে একাউন্ট চালায়। যারা খ্যাতির শীর্ষে, তাদের অন্যকিছুতে মাথা দেয়ার মতো সময় নেই। অন্য শিল্পীদের মুভি দেখা, গান শোনা, বা খেলা দেখে বিনোদন নেয়ার সময় নেই। তারা এতটাই প্রফেশনাল। নিজেদের 'প্যাশন' নিয়ে এতটাই ব্যস্ত। কীভাবে মানুষকে আরো মাতিয়ে রাখা যায়, টপ লিস্টেড আর্টিস্ট হওয়া যায়, রেকর্ড পরিমাণ লাইক-ভিউস পাওয়া যায়, সেজন্য তারা দিনরাত পাগলের মতো খেটে চলেছে। 

 

এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা, কয়েকটা বাচ্চা মেয়ে প্রিয় ব্যান্ডের গায়কদের সাথে দেখা করবে বলে ঘরছাড়া হয়েছিল। বাবা-মা, ভাইবোন ছেড়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা বাড়ি ছাড়ল, তাদের কথা সেসব সেলেবরা একবার খোঁজ নিয়েছে? মেয়েগুলো কেমন আছে একটু চিন্তা করেছে? হয়তো ঘটনাটা জানলেও এরা কেয়ার করবে না। নিজেদের ফেইম কত বেড়েছে, ভক্তরা কত পাগল এসব ভেবে মনে মনে খুশি হবে। মেয়েগুলোর কী হলো এটা তাদের ভাববার বিষয় না। 

 

সত্যি বলছি, তোমার মতো একটা তুচ্ছ ভক্তের কথা ভেবে একটা মুহূর্ত খরচ করার মতো সময় বা ইচ্ছা, কোনোটাই এসব সেলেবের নেই। মুখে যত বড় বড় ভালোবাসার কথাই বলুক না কেন, তুমি দেখবে, ভক্তরা জোর করে জড়িয়ে ধরলে সে বিব্রত হয়, অতিরিক্ত টানাটানি করলে অপছন্দ করে, পাছে তার ড্রেস-আপ বা মেইক-আপ নষ্ট হয়ে যায়! হয়ত ব্যাকল্যাশের ভয়ে সামনা-সামনি কিছু বলতে পারে না। তুমি তার জন্য 'আই লাভ ইউ' পোস্টার হাতে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকো, তাকে চুমু খাও, সে তোমার চেহারাটাও মনে রাখবে না। অল্প কিছুক্ষণের ভেতরই তোমাকে ভুলে যাবে। 

 


কিন্তু জানো, সব সেলেব ভুলে গেলেও একজন তোমাকে ভুলবে না। কখনো ভুলেনি। সেই মানুষটা তোমার জন্য নিজের সারাটা জীবন কষ্ট সহ্য করেছে। নিজের আরাম-আয়েশ সব বিসর্জন দিয়েছে। তোমার কাছে একটা 'মেসেজ' পৌঁছাবে বলে নিজের দেশছাড়া হয়েছে। পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছে। তোমার কথা ভেবে ভেবে চোখের পানি ফেলেছে। 

  


তাঁর কথা কি তুমি ভুলে গেলে? 


তিনি আর কেউ নন,
আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
চেনো তুমি তাকে? কতখানি চেনো, বলো তো? 


রাসূলুল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসতেন ঠিক তখন থেকে যখন আমরা জন্মও হই নি। কীসে আমাদের ভালো, কীসে আমাদের মুক্তি, কীসে আমরা বোকার মতো জড়িয়ে পড়ব, এসব নিয়ে উনার চিন্তার শেষ ছিল না। জান্নাত তো লেখাই ছিল উনার জন্য, তবু উনি রাতভর নামাজ পড়তেন, নামাজ পড়তে পড়তে পা ফুলিয়ে ফেলতেন, আল্লাহর কাছে হাত তুলে দুয়া করতেন যেন আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করে দেয়। চোখের পানি ফেলে ফেলে দুয়া করতেন যেন আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাত দেয়। 

এই ভালোবাসা তোমাদের চোখে পড়ে না?

এই মানুষটাকে কি তোমরা ভালোবাসো না? 


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এতটাই ভালোবাসেন যে কিয়ামতের দিনেও তিনি বলতে থাকবেন, আমার উম্মত, আমার উম্মত! কোনো সেলেব কি নিজের ভক্তকে এভাবে ভালোবাসতে পেরেছে? নিজের ভক্তের জন্য জান কুরবান করেছে? সত্যি কি জানো? এখনকার সেলিব্রিটিরা তাদের ভক্তের পিছে দশটা মিনিটও খরচ করবে না। তুমি মরে যাও, আত্মহত্যা করো, কিচ্ছু যাবে-আসবে না তোমার ভালোবাসার অমুক-তমুক সেলেবের। তুমি রাতভর কেঁদে বালিশ ভিজাও, কেউ জানবে না। কোনো সেলেব্রিটি প্রশ্ন করবে না, কেন তুমি কেঁদেছ? তোমাকে গোণার টাইম ওদের নাই। তুমি ওদের কাছে স্রেফ একটা ক্লায়েন্ট, একটা কাস্টমার। একটা ভ্যালুলেস, ব্রেইনলেস, স্টুপিড 'ফ্যান' ছাড়া আর কিছুই না। তোমাকে ওদের প্রডাক্ট (গান বা অভিনয়) গেলাতে পারলেই ওদের বিজনেস। কাড়ি কাড়ি টাকা, ফেইম, অন্যান্য কম্পানিতে আরো বেশি বেশি হায়ার হওয়ার সুযোগ। তোমার কী লাভ? এই ভালোবাসা, এই আশেকী, এই পাগলামি, এই নাচানাচি, কী দেবে তোমাকে? কিছুই না! কেন খালি খালি অপাত্রে নিজেকে বিলাচ্ছ? কেন মানুষের ভালোবাসায় কাতর হয়ে হারামে জড়াচ্ছ? কেন অন্যের 'দুনিয়া' বানাতে নিজের আখিরাত হারাচ্ছ? 

 

সময় থাকতে সরে এসো। 

কিছুদিন আগে আমাদের পরিচিত একজন মারা গেছে। বয়স মাত্র সতেরো কি আঠারো। টগবগে প্রাণ। পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, কী ছিল না ওর জীবনে? ওর বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুরা কেউ কল্পনাও করেনি এত অল্প বয়সে ও চলে যাবে। আমরা কেউই জানিনা আমরা কবে মারা যাব, আমরা কেউই ভাবিনা মৃত্যুর সময়টা অল্প বয়সেও আসতে পারে। ওর চলে যাওয়ার পর সবাই, সবকিছু কিন্তু আগের মতোই আছে। বন্ধুদের আড্ডা, কনসার্ট, পড়াশোনা, কিছুই থেমে নেই। শুধু ওর হার্টবিটটা থেমে গেছে। 

 

 

এভাবেই একদিন হুট করে আমরাও চলে যাব৷ কেমন হবে, যদি মারা যাওয়ার পরে কিয়ামতের দিনে দেখো, তোমার জন্য তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি অপেক্ষা করে আছে। যাকে তুমি কোনোদিন দেখো নি, যার সাথে তুমি কোনোদিন সরাসরি কথা বলো নি, শুধু তাঁর কথা শুনে এসেছ সেই ছোট্টটি থেকে। এরপর তাকে বিশ্বাস করেছ। এরপর তাঁর কথামতো জীবন গড়েছ। তাকে যখন নিজের সামনে দেখবে, কেমন হবে সেই মুহূর্ত? 

 

 

বন্ধু-গান-আড্ডায় ভুলে যেও না কেন তুমি এই পৃথিবীতে এসেছ। ভুলে যেও না মৃত্যুর পর একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন এক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আর কেউই আমাদের হয়ে কথা বলবে না। আল্লাহ যেন আমাদেরকে রাসূলকে ভালোবাসার তাওফিক দেয়। রাসূলের দেখানো পথে চলার তাওফিক দেয়। আমীন।


আনিকা তুবা

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন