চাহিদা একটা অসীম জিনিস। এর কোনো শেষ নেই। তবে এটার নিয়ন্ত্রণের ভার ব্যক্তির নিজের ওপর। ক্ষুধা লাগা বন্ধ করার ক্ষমতা মানুষের নেই। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের উপকরণ বাছাইয়ের ক্ষমতা মানুষের আছে। যে সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকবে তার চাহিদা হবে সসীম। আর যে উলটোটা করবে তার চাহিদা হবে অসীম। এই কথাটা অন্যান্য চাহিদাগুলোর বেলায়ও প্রযোজ্য। লোভকে প্রশ্রয় না দিলে নিজের আত্মাকে তুষ্ট করা সহজ হয়ে যায়। মিথ্যাকে যদি সকল পাপের মা বলা হয়। তাহলে লোভকে সকল পাপের পথ বলা উচিত।
মানুষ তার নিজের অস্থিরতা নিজেই বাড়িয়ে তোলে। তার আয় ২ টাকা। কিন্তু সে লোভ করে ৫ টাকা মূল্যের জিনিসের। বাকি ৩ টাকা কোথায় পাবে সেটা সে জানে না। এই ৩ টাকা জোগাড় করতে গিয়েই তার জীবন নানান রকমের সমস্যায় জর্জরিত হয়। তখন সমাধান খুঁজে পেতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। অসৎ কাজ করে। মানুষের অধিকার নষ্ট করে। অন্যের সম্পদ মেরে খায়। অন্যায়ের সাথে আপোষ করে। হারাম পথে উপার্জন করে। ইসলামকে কাট-ছাঁট করে পালন করে। প্রয়োজনে মানুষও খুন করে ফেলে। আর ইসলাম! সেটা তো জীবন থেকে কবেই পালিয়ে যায়। আপাদমস্তক সদ্য কুখ্যাত মানুষে পরিণত হওয়া ব্যক্তিটার মাথার ওপরে ইসলাম নামক রহমতের চাদরটা থাকে না। তখন সে ইসলামের লেবাস ধারণ করে নিজেকে ধার্মিক সাজানোর ও ধার্মিক বানানোর চেষ্টা করে।
তবে তার পথটাই যখন ভিন্ন, তখন ভিন্ন পথের পরিবেশটা তো ভিন্ন হবেই। সে তখন তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বাঁকা পথ ধরেই হাঁটতে শুরু করে। বাঁকা পথকে ভুলক্রমে সোজা পথ মনে করে হাঁটে? মোটেই না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কাউকে ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট করেন না বা পথভ্রষ্ট হওয়ার সুযোগ দেন না–যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া হয়; অর্থাৎ তাকে হিদায়াত দেওয়া হয়।
"আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়কে হিদায়াত দানের পর তাদেরকে গুমরাহ করেন না যে পর্যন্ত না তিনি তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেন কোন বিষয়ে তাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে।"
(সুরা আত তাওবাহ : আয়াত ১১৫)
হিদায়াত এমন এক জাদু যা মিথ্যাকে সত্য থেকে পৃথক করতে শেখায়। অসচ্ছকে সচ্ছ করে দেয়। অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। অন্ধকে দৃষ্টি দান করে। নির্বোধকে দূরদর্শী বানায়। উদাসীনকে চিন্তাশীল করে তোলে। জড়বুদ্ধিসম্পন্নকে সূক্ষ্মবুদ্ধির অধিকারী বানায়। বন্দীকে মুক্ত বাতাসে উড়তে শেখায়। কিন্তু হিদায়াত পাওয়ার পর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার যেই গুরু দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়েছিল, সেই দায়িত্বকে সে কৌশলে এড়িয়ে যেতে চায়। নানান অজুহাত দাঁড় করায়। তার অন্তর যে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে, সে যে দুনিয়াবি চাকচিক্যের প্রতি ফের আকৃষ্ট হয়েছে, সে যে আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে, সে যে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে, সেসবের পক্ষে সে যুক্তি দাঁড় করায়। সে যা করার বুঝে-শুনেই করে। এক কথায় বললে–সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে নাফরমানী করে।
কিভাবে?
প্রথম প্রথম হিদায়াত পাওয়ার পর একটা মানুষ নিষ্পাপ শিশুর মতো হয়ে যায়। তার অন্তরটা তখন সবচেয়ে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে। একটা ফেরেশতা আর এই মানুষটার মাঝে খুব বেশি একটা পার্থক্য থাকে না। মানুষটার এই সময়কার অন্তরটাকে যদি বের করে দেখানো হতো–তখন দেখা যেত টলটলে সচ্ছ পানির মতো একটা অন্তর। অন্তরটা কুসুমের চেয়েও কোমল। আকাশের মতো বিশাল। পাহাড়ের মতো শান্ত। মাটির মতো শীতল। নদীর স্রোতের মতো সরল। অন্তরে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই, দম্ভ-অহংকার নেই, লোভ-লালসা নেই, অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা নেই। আছে শুধু নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা।
ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হক আদায়ের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় কাজগুলোর ব্যাপারে সে বেশ উদগ্রীব থাকে তখন। চারদিকে মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট দেখে তার অন্তর হুহু করে কেঁদে ওঠে। অসহায় মুসলমানদের উদ্ধার করতে না পেরে নিজের অক্ষমতার জন্য সে বিমর্ষ ও নির্জীব হয়ে থাকে। অনবরত তার হৃদয় ও মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে। একসময় সেটা ক্রোধ ও জেদে পরিনত হয়। সে নির্লিপ্তভাবে মহান রবের সাথে এই মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় যে–দুনিয়াপ্রীতি, স্বার্থ, ভোগ-বিলাসিতা পরিত্যাগ করে সে মুসলিমদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে।
বান্দার এই অঙ্গীকারে আরশের মালিক ভিষণ খুশি হন৷ কুরআনুল কারিমের মূল শিক্ষা এটাই। নবীদের কাজ এটাই ছিল। নবীওয়ালা কাজ এটাই। সাহাবীগণও (রা.) এটাই করেছেন।
তবে এই অবস্থাটা ক্ষনস্থায়ী। সে কয়েক দিনের ফেরেশতা। এটা বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। দিন যত গড়াবে তার এই পবিত্র ও পরিশুদ্ধ অন্তরটা ধীরে ধীরে কলুষিত হতে থাকবে। হিদায়াত অমূল্যবান এক সম্পদ। এটা চুরি হতে পারে কিংবা ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে। হিদায়াতপ্রাপ্ত একজন মুসলমানের পরীক্ষা এখানেই। তাকে ডেকে এনে অমূলবান সম্পদটা দেওয়া হবে৷ তবে বাকি কাজটা তাকে নিজ দায়িত্বে একাই করতে হবে।
ব্যাপারটা অনেকটা একটা শিশুর সাথে তুলনীয়। ছোট্ট শিশু যখন হাঁটতে শিখেনি, তখন তাকে হাত ধরে হাঁটানো হয়, কোলে তুলে রাখা হয়। একটু বড়ো হলে হাতটা যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন সে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায়। হোঁচট খেয়ে কিন্তু বসে থাকে না। আবার উঠে দাঁড়ায়। এক পা দুই পা করে হাঁটে। এরপর একটু জোরে হাঁটে। এরপর আরেকটু জোরে। এরপর দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌছে যায়।
কিন্তু এই পথভ্রষ্ট মানুষগুলোর ক্ষেত্রে হয়ে যায় ভিন্ন কিছু। তারা হোঁচট খেয়ে হয় বসেই থাকে। অথবা হামাগুড়ি দিয়ে বাঁকা পথে চলে। কিছু দূর পথ চলে কুকুরের মতো জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে। পথ না চলে যদি ঠায় বসেও থাকে, তখনও জিভ করে হাঁপাতে থাকে। আর চোখ-মুখ কুঁচকে বলতে থাকে–দ্বীন পালন করা খুব কষ্ট! আর পারি না! এরপর বলে–অর্থ সংকট এমন জিনিস যা ঈমান ত্যাগ করার মতো পর্যায়ে নিয়ে যায়! এরপর আল্লাহর রাসূলের (সা.) একটা হাদিসের অপব্যাখ্যা দেয়।
অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজেও দরিদ্র জীবনযাপন করতেন। কত সাহাবী (রা.) ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজেদের সম্পদ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হিজরত করেছেন, দরিদ্র জীবনযাপন করেছেন। দিনের পর দিন ক্ষুধার্ত থেকেছেন। তারা কি এই হাদিসটা শোনেননি। অবশ্যই শুনেছেন এবং বুঝেছেন। কিন্তু এই পথভ্রষ্ট মানুষগুলো হয় না বুঝে অথবা বুঝে-শুনে হাদিসটার অপব্যাখ্যা করেছে। অথচ হাদিসে দারিদ্র্যতা বলতে সেটাকেই বোঝানো হয়েছে, যেটা এই প্রবন্ধের একেবারে শুরুতেই উল্লেখ করেছি। প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে দারিদ্র্যতা থেকে মুক্ত থাকা আর বিলাসিতার জন্য দুনিয়ার পেছনে হন্যে হয়ে ছোটা এক জিনিস না। তর্ককারীরা এখন বলতে পারে–না না, এসব মনগড়া ব্যাখ্যা মানি না। তাহলে কুরআনুল কারিমের একটা আয়াত দেখাই।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
"ওটা না তোমাদের মাল-ধন, আর না তোমাদের সন্তান-সন্ততি যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করবে। তবে যে কেউ ঈমান আনে আর সৎকাজ করে তাদেরই জন্য আছে বহুগুণ প্রতিদান তাদের কাজের জন্য। তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে।" (সুরা সাবা : আয়াত ৩৭)
পর্ব ২ পড়ুন
লিখেছেনঃ কারিম শাওন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন