দুনিয়াখোর পর্ব ২

 


কুফুরি করা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি ঈমান রাখার ঠিক উলটো কাজ। যে ঈমানের পথে হাঁটল, সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকটবর্তী হলো। যে কুফুরি করল সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার থেকে দূরে সরে গেল। সহজ হিসেব। তো দারিদ্র্যতা যদি কুফুরির দিকেই ধাবিত করে তাহলে এই আয়াতে কেন বলা হচ্ছে–সম্পদের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করা যাবে না? আয়াতটা তো হওয়া উচিত ছিল–বেশি বেশি সম্পদ অর্জন করো, আর আমার নৈকট্য লাভ করো।


কুরআনুল কারিমে এমন আয়াত আছে যেখানে কাফেররা রাসূলের (সা.) সম্পদ না থাকার ব্যাপারে উপহাস করে কথা বলেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেই কথার বিপরীতে আয়াত নাযিল করেছেন।


"‘তাকে ধন-ভান্ডার দেওয়া হয় না কেন, অথবা তার জন্য একটা বাগান হয় না কেন যাত্থেকে সে আহার করত?’ যালিমরা বলে–‘তোমরা তো এক যাদুগ্রস্ত লোকেরই অনুসরণ করছ।’ দেখ, তারা তোমার ব্যাপারে কেমন সব উপমা পেশ করছে! যার ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, অতএব তারা কোনো ক্রমেই পথ পাবে না। মহা কল্যাণময় তিনি যিনি ইচ্ছে করলে তোমাকে ওগুলোর চেয়েও উৎকৃষ্ট জিনিস দিতে পারেন–বাগ-বাগিচা, যার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে নির্ঝরিণী, দিতে পারেন তিনি তোমাকে প্রাসাদরাজি।" 

(সুরা আল ফুরকান : আয়াত ৮-১০)


এমন আয়াত আছে যেখানে ধন-সম্পদের অধিকারীকে তিরস্কার করা হয়েছে। ধনীদের হুমকি দেওয়া হয়েছে।


"আমি যাকে ওয়াদা দিয়েছি, কল্যাণের ওয়াদা আর সেটা সে পাবেও, সে কি ওই ব্যক্তির সমান যাকে আমি পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্ভার দিয়েছি, অতঃপর ক্বিয়ামতের দিন তাকে হাজির করা হবে (অপরাধীরূপে)?" 

(সুরা আল কাসাস : আয়াত ৬১)


"জাহান্নাম সেই ব্যক্তিকে ডাকবে যে পেছনে ফিরে গিয়েছিল এবং সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে মালধন জমা করত, অতঃপর তা আগলে রাখত।" 

(সুরা আল মা'আরিজ : আয়াত ১৭-১৮)


"যে ধন-সম্পদ জমা করে আর বার বার গণনা করে, সে মনে করে যে, তার ধন-সম্পদ চিরকাল তার সাথে থাকবে, কক্ষনো না, তাকে অবশ্যই চূর্ণ-বিচূর্ণকারীর মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে, তুমি কি জান চূর্ণ-বিচূর্ণকারী কী? তা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন, যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। 

(সুরা আল হুমাযাহ্ : আয়াত ২-৭)


এমন আয়াত আছে যেখানে মানুষ ধন-সম্পদের প্রতি বেশি আসক্ত বলে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে।


"তোমরা উত্তরাধিকারীদের সব সম্পদ খেয়ে ফেল। আর তোমরা ধন-সম্পদকে অতিরিক্ত ভালবাস। এটা মোটেই ঠিক নয়।" 

(সুরা আল ফাজর্ : আয়াত ১৯-২১)


"ধন-সম্পদের প্রতি অবশ্যই সে খুবই আসক্ত। সে কি জানে না, কবরে যা আছে তা যখন উত্থিত হবে।" 

(সুরা আল 'আদিয়াত : আয়াত ৮-৯)


"অধিক (পার্থিব) সুখ সম্ভোগ লাভের মোহ তোমাদেরকে (অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে) ভুলিয়ে রেখেছে। এমনকি (এ অবস্থাতেই) তোমরা কবরে এসে পড়। (তোমরা যে ভুল ধারণায় ডুবে আছো তা) মোটেই ঠিক নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, আবার বলি, মোটেই ঠিক নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।" 

(সুরা আত তাকাসুর : আয়াত ১-৪)


এমন আয়াত আছে যেগুলো মানুষকে ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য উৎসাহিত করবে বা এই কাজকে সমর্থন করবে তো দূরের কথা; বরং ধন-সম্পদের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই নিষেধ করা হয়েছে। পার্থিব এসব ভোগ-সম্ভারের ব্যাপারে মুসলমানদের কেমন হওয়া উচিত সেটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর রাসূলকে (সা.) বলার মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছেন।


"তুমি দুনিয়ার দ্রব্য-সামগ্রীর প্রতি চোখ তুলে তাকিও না যা আমি তাদের বিভিন্ন লোকেদের দিয়েছি।" 

(সুরা আল হিজর : আয়াত ৮৮)


"তুমি কক্ষনো চোখ খুলে তাকিও না ওই সব বস্তুর প্রতি যা আমি তাদের বিভিন্ন দলকে পার্থিব জীবনে উপভোগের জন্য সৌন্দর্য স্বরূপ দিয়েছি, এসব দিয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। তোমার প্রতিপালকের দেওয়া রিযকই হলো সবচেয়ে উত্তম ও সবচেয়ে বেশি স্থায়ী।" 

(সুরা ত্ব-হা : আয়াত ১৩১)


"হে নবী (সা.)! তুমি তোমার স্ত্রীদের বলে দাও–তোমরা যদি পার্থিব জীবন আর তার শোভাসৌন্দর্য কামনা কর, তাহলে এসো, তোমাদেরকে ভোগ-সামগ্রী দিয়ে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদেরকে বিদায় দেই।"


 (সুরা আল আহযাব : আয়াত ২৮)


তো ভাই আপনারা এগুলো কি বলেন? আপনাদের কথার সাথে তো কুরআনুল কারিমের কথাগুলো মেলে না। মেলে না আমার রাসূলের (সা.) জীবনযাপনের সাথে মেলে না। রাসূলের (সা.) সাহাবিদের (রা.) জীবনযাপনের সাথে। আমার রাসূল (সা.) ছিলেন পৃথিবীর সর্বশেষ্ঠ মানুষ। অথচ তিনি মাটিতে পেতে রাখা খেজুরের পাতার তৈরি পাটিতে ঘুমাতেন। তার ঘরের আসবাব বলতে ছিল পানির একটা পাত্র। মদিনায় হিজরত করার পর ক্ষুধার তাড়নায় পেটে পাথর বেঁধেছিলেন। তার সাথে সাথে পাথর বেঁধেছিলেন আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)। আহলুস সুফফার সাহাবিরা (রা.) দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়েছেন। মুসআব ইবন উমায়েরের (রা.) মতো ধনীর দুলাল তালি দেওয়া চামড়ার পোশাক পরে জীবন কাটিয়েছেন।


ওমর (রা.) তার গভর্নরদের বাসগৃহ পরিদর্শনে যেতেন এটা দেখার জন্য যে–দুনিয়ার চাকচিক্যময় উপকরণ তাদের ঘরে আছে কি না। সেরকম কিছু থাকলে সেগুলো ধ্বংস করে দিতেন। মুসলিমরা শামের ভূমিতে গণিমতের জমি পেয়ে ফসলের চাষবাসে মনোযোগী হয়ে পড়েন। খবর শুনে ওমর (রা.) ফসলগুলো পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত সময় নিলেন। পেকে যাওয়ার পর ফসলগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কোনো গভর্নর বিলাসিতা করলে তাকে মদিনায় ডেকে এনে শাস্তি দিতেন। একদিন ওমর (রা.) পরিদর্শনে গিয়ে আবু উবাইদা ইবনুল জাররা (রা.), খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.), ইকরিমা বিন আবু জাহেলকে (রা.) দেখতে পেলেন দামি পোশাক পড়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। ওমর (রা.) উট থেকে নেমে তাদেরকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করা শুরু করলেন। এরপর বললেন–এত দ্রুত তোমরা কীভাবে বদলে গেলে!


সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্মকে নিয়ে এগুলো বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা বললাম। বলতে থাকলে পাতার পর পাতা শেষ হবে। তবুও তাদের দুনিয়াবিমুখতার অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলো বলা শেষ হবে না। আপনাদের চোখে কি এসব ঘটনা পড়ে না? আপনারা কি কখনো এসব ঘটনা শোনেননি? আপনারা কি সত্যি সত্যিই গোমরাহ হয়ে গেলেন? দুনিয়া কি সত্যি সত্যিই আপনাদের ওপর চেপে বসল? শয়তান কি সত্যি সত্যিই আপনাদেরকে সঠিক পথটা ভুলিয়ে দিল?


তাদেরকে আপনি সাহাবিগণের (রা.) ওই কাহিনিগুলোই বর্ণনা করতে দেখবেন যেই কাহিনিগুলোতে সম্পদ অর্জনের কথা আছে। অন্য দিকে আবার ওই একই সম্পদশালী সাহাবিদের (রা.) যুদ্ধের ময়দানের কথাগুলো তারা বেমালুম চেপে যায়। অনেক তথাকথিত দাঈকেও দেখছি আজকাল ধনী হওয়ার গল্প শোনাচ্ছে। কিভাবে কিভাবে আরও দুনিয়াদার হওয়া যায় সেই ছবক দিচ্ছে। ছবকের দলীল হিসেবে ধনী সাহাবিগণকে (রা.) টেনে আনছে। 


খুঁজলে ধনী সাহাবিগণের (রা.) তুলনায় দুনিয়াবিমুখ সাহাবিগণের (রা.) দৃষ্টান্তই বেশি পাওয়া যাবে। থাক সেদিকে না হয় না গেলাম। কিন্তু এই ধনী সাহাবিগণ (রা.) ইসলামের জন্য একসময় সম্পদ হারিয়েছেন, দরিদ্র হয়েছেন, ক্ষুধার কষ্টে পেটে পাথর বেঁধেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, হিজরত করেছেন, জিহাদ করেছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন, এরপর কেউ কেউ পুনরায় ধনী হয়েছেন। 


পুনরায় ধনী হয়ে কিন্তু সম্পদের মাঝে ডুবে থাকেননি। সেই সম্পদ ইসলামের জন্য অকাতরে বিলিয়েছেন। অনবরত অন্যদেরকে সম্পদ বিমুখ হতে তাগিদ দিয়েছেন। ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবিগণকে (রা.) সম্পদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আমিরুল মুমিনিন ওমর (রা.) কত কিছুই না করেছেন। যুন নুরাইন উসমান (রা.) খলিফা হয়ে কবুতরের খেলার সামান্য বিলাসিতা নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ তখন ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে জিহাদ ফরজে কিফায়া হয়ে গেছে। 

পর্ব ৩ পড়ুন

লিখেছেনঃ কারিম শাওন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন