দুনিয়াখোর পর্ব ৩

তারা এগুলো না বলে শুধু ধনী হওয়ার গল্প শোনান কেন? মুসলিমরা যখন সম্পূর্ণভাবে দুনিয়ামগ্ন হয়ে আছে তাদের কাছে ধনী হওয়ার গল্পটা মাতালকে আরও মদ খাওয়ানোর সামিল। অথচ এখন জিহাদ ফরজ।


রাসূল (সা.) মিষ্টি জাতীয় খাবার পছন্দ করতেন। এই হাদিস বর্ণনা করেন। কারণ, খাবার খেতে তো রক্ত দেওয়া লাগে না; বরং মজা লাগে। রাসূল (সা.) জিহাদ করেছেন সেটা কিন্তু তারা বলেন না। ইসলামকে মিলাদের জিলাপি বানিয়ে ফেলেছে। নিজেরা দুনিয়াখোর হয়েছে আগেই। এখন অন্যদেরকেও দুনিয়াখোর বানানোর পায়তারা। লেজকাটা শেয়ালের ওই গল্পটার মতো তাদের স্বভাব।


আসমানের নিচে আর জমিনের ওপরে–অর্থাৎ আসমান-জমিনের মাঝে বসবাস করা এই পথভ্রষ্ট মানুষগুলোর নাম আমি দিয়েছি দুনিয়াখোর। চাখোর, পানখোর, বিড়িখোর, নেশাখোর, ঘুষখোর, সুদখোর, জুয়াখোর, নারীখোর নামগুলো তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। দুনিয়াখোর নামটা হয় তো এই প্রথম শুনলেন। এতটা সময় যাদের নিয়ে কথা বললাম তারাই দুনিয়াখোর। এই দুনিয়াখোররা দ্বীনদারির নামে দুনিয়াদারী করে।


আমরা দেখব রাসূল (সা.) কেমন ছিলেন? তিনি কিভাবে জীবন কাটিয়েছেন? তিনি সম্পদের পেছনে ছুটেছেন কি না? তার সম্পদ বলতে কি ছিল? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর রাসূলকে (সা.) পবিত্র কুরআনুল কারিমে পার্থিব ভোগ-সম্ভারের ব্যাপারে কি কি নির্দেশ দিয়েছেন?


রাসূল (সা.) আমাদের জন্য অনুকরণীয়। সাহাবায় একরাম (রা.) আমাদের জন্য অনুসরণীয়। সাহাবায় একরাম (রা.) রাসূলকে (সা.) যেভাবে অনুকরণ করতেন, আমরা সাহাবায়ে একরামকে (রা.) অনুসরণ করে রাসূল ( সা.)-এর অনুকরণ করব। এই ক্ষেত্রে অনুসরণ ও অনুকরণ পৃথক।


জীবিকার ব্যাপারে রাসূল (সা.) একেবারে সাধারণ ছিলেন। খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিব্র ক্ষুধার তাড়না সহ্য করেছেন। অভাব-অনটনে জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরে মাসের পর মাস চুলা জ্বলেনি। তবুও তার উম্মত অর্থ-বিত্তের পেছনে ছুটছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি মুহাম্মাদ (সা.)-কে দাউদ (আ.) কিংবা সুলাইমান (আ.) কিংবা আইয়ুব (আ.)-এর মতো ধনী নবী বানাতেন, তাহলে এই শেষ নবীর (সা.) উম্মতরা না জানি কি করত!


অথচ তারা যখন কয়েক দিনের ফেরেশতায় রূপান্তরিত হয়েছিল, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে–তারা জিহাদ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে। এর জন্য তারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা ত্যাগ করে সংগ্রামী জীবনযাপন করার জন্য মনস্থির করেছিল। বাতিলের সাথে আপোষহীনভাবে চলার প্রতিজ্ঞা করেছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে যারা বিদ্রোহ করেছে, তাদেরকে নিজের প্রধান শত্রু বানিয়ে নিয়েছিল।


হায়! এখন তাদের কি হলো! কোন পাপে তারা জড়ালো–যে কারণে ঘুণপোকা তাদের হিদায়াত খেয়ে ফেলছে!


হিদায়াত একটা বীজের মতো। বীজটা তাকে অনুগ্রহসরূপ দেওয়া হয়। তার কাজ–


১. প্রথমে মনের জমিনের আগাছা পরিষ্কার করা। (অর্থাৎ শিরক মুক্ত হওয়া।)


২. এরপর নিড়ানি দেওয়া। (অর্থাৎ ঈমানের মৌলিক জ্ঞান আহরণ করা।)


৩. এরপর বীজটাকে বপন করা। (অর্থাৎ বুঝে কালেমার সাক্ষ্য প্রদান করা)।


৪. নিয়মিত পানি দেওয়া। (অর্থাৎ নিয়মিত ইবাদাত করা।


৫. চারা গজানোর পর একটু বড়ো হলে চারপাশে বেড়া দেওয়া, যেন তৃণভোজীরা খেয়ে না ফেলে। (অর্থাৎ বাতিল ফিরকার সাথে জড়িয়ে পথভ্রষ্ট না হওয়া।)


৬. চারা গাছটা আরেকটু বড়ো হলে পাশে একটা খুঁটি গেথে দেওয়া, যেন ঝড়ের কারণে গাছটা হেলে না পড়ে। (অর্থাৎ ফিতনা থেকে বেঁচে চলা)।


এভাবে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পরিচর্যা অব্যহত রাখলে একসময় গাছটা বড়ো হয়ে নিজ কান্ডের ওপর মজবুত হয়ে দাঁড়াবে। সুমিষ্ট ফল দেবে। ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় দেবে।


সব কিছু বোঝার পরেও দুনিয়াপ্রীতির কারণে বাঁকা পথ ধরলে ওই বীজ থেকে চারাটাও গজাবে না; ফল দেবে তো দূরের কথা। আর চারা যদি গজায়ও তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। কিংবা ছাগল ভক্ষণ করে ফেলবে। কিংবা ফিতনায় জড়িয়ে দুনিয়াখোর হয়ে যাবে। তাদের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। 


আসলে তাদের বিবেক তাদেরকে অঙ্গীকার করতে বাধ্য করেছিল তখন। তাদের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে–জমিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতিনিধি হিসেবে কোন কাজটা করা তাদের জন্য এখন বাধ্যতামূলক। কোন কাজের মাধ্যমে তারা তাদের মহান রবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কি করলে মহান সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যাবে। পৃথিবীতে মুসলিমদের ওপর এত অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনে তাদের কি ভূমিকা পালন করা উচিত। তাদের শিশুর মতো অন্তরটা তখন সব কথার উত্তরে সায় দিয়ে বলেছিল– দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসিতা ত্যাগ করে, আখিরাতকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য দিয়ে, দুনিয়াকে পুরোনো কাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করব। যুদ্ধ করে রক্ত দেব, প্রাণ দেব। কাফেরদের হাত থেকে মুসলিমদের মুক্ত করব। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করব। কারণ, একমাত্র এই কাজের দ্বারাই মহান রব সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হবেন।


কিন্তু যখনই হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের পায়ে হাঁটতে দেওয়া হলো, মনের নিয়ন্ত্রণ যখন তাদের নিজেদের ওপর দিয়ে দেওয়া হলো, তখন তারা বাঁকা পথ ধরল। অঙ্গীকার ভঙ্গ করল। তারা যা করার বুঝে-শুনেই করল। বস্তুত তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে নাফরমানী করল। ইন্না লিল্লাহ!


"তারাই হিদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী ক্রয় করেছে, কিন্তু তাতে তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি, আর তারা সৎপথপ্রাপ্তও নয়।" (সুরা আল বাকার : আয়াত ১৬)


"নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে, এরা আখেরাতের কোনো অংশই পাবে না এবং আল্লাহ ক্বিয়ামাতের দিন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না, বস্তুতঃ তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" (সুরা আল ইমরান : আয়াত ৭৭)


কতজন মুসলিম মোটামুটি ইসলামের প্রতি অনুরাগী? তাদের মধ্যে কতজন মাঝে মাঝে সালাত আদায় করে? তাদের মধ্যে কতজন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে? তাদের মধ্যে কতজন প্রতিদিন কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করে? তাদের মধ্যে কতজন প্রতিদিন তরজমা সহ কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করে? তাদের মধ্যে কতজন পবিত্র কুরআনুল কারিমের তরজমা পড়তে গিয়ে–পার্থিব ভোগ-বিলাসিতা ত্যাগ করে জিহাদের দিকে ধাবিত হতে আহবান জানানো আয়াতগুলো বোঝে? তাদের মধ্যে কতজন এই আয়াতগুলো পালনীয় সেটা বোঝে? তাদের মধ্যে কতজন উপলব্ধি করে যে, এই আয়াতগুলো আসলে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে?


সবগুলো প্রশ্নের উত্তর 'অল্প সংখ্যক' থেকে ক্রমাগত 'তার চেয়ে অল্প' 'তার চেয়েও অল্প' 'তার চেয়েও অল্প' হতে থাকে, যা একমাত্র হিদায়াত পাওয়া মানুষগুলোই উপলব্ধি করতে পারে। যারা হিদায়াত না পেয়েছে তাদের কথা বাদ দিচ্ছি। যারা হিদায়াত পেয়েও সেটা কাজে লাগায়নি, তাদের চেয়ে বড়ো কপাল পোড়া আর কে হতে পারে! 


লিখেছেনঃ কারিম শাওন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন