গোলকধাঁধাময় পৃথিবীতে কত মানুষ পথহারা হয়ে ঘুরে মরছে। তাদের কাছে পথের কোনো ঠিকানা নেই। জীবনের কোনো দর্শন নেই। পুনরুত্থানের কোনো বিশ্বাস নেই। আখিরাতে জবাবদিহিতার কোনো ভয় নেই। সৃষ্টিকর্তার সাথে কোনো সংযোগ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। এই পথহারা মানুষগুলো অন্ধ, বধির ও মূক। হিদায়াতের স্বাদ কি তা তারা জানে না।
অথচ হিদায়াত পাওয়ার পর পুনরায় পথভ্রষ্ট হওয়া এই মানুষগুলোকে কোটি কোটি মানুষের মাঝ থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল– দুনিয়া কি, জীবন কি, মৃত্যু কি। হাতে কুরআনুল কারিমের আলো, চোখে সচ্ছ দৃষ্টি, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারার মতো জ্ঞান দান করে তাদেরকে বলা হয়েছিল–এবার পথ চলো। সাবধানে চলবে। কেবল মাত্র তোমার রবের সন্তুষ্টি অর্জন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারলেই তুমি সফল হবে। আফসোস! কে শুনল এসব কথা! কে হাঁটল এই মুক্তির পথে!
তবে সবাই এমন না। অঙ্গীকার করলে সবাই যে তা ভঙ্গ করে তা কিন্তু না। পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজেই সেসব সত্যবাদীদের ব্যাপারে বলেছেন।
"মু’মিনদের মধ্যে কতক লোক আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তাদের কতক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে (শাহাদাত বরণ) করেছে আর তাদের কতক অপেক্ষায় আছে। তারা (তাদের সংকল্প) কখনো তিল পরিমাণ পরিবর্তন করেনি।" (সূরা আল আহযাব : আয়াত ২৩)
আসলে শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে। আর এ জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। শুরুতেই তারা হিদায়াতের পথ থেকে ছিটকে পড়ে না। তাদের নফস এবং শয়তান তাদেরকে একটু একটু করে ভুল পথে নিয়ে যায়।
প্রথমে তারা কুরআনুল কারিমের এই আয়াতটা–
"অতঃপর যখন নামায সমাপ্ত হয়, তখন যমীনে ছড়িয়ে পড়, আর আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে থাক–যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করতে পার।"
(সূরা আল জুমুআহ : আয়াত ১০)
দেখিয়ে বলে, এই যে আল্লাহ বলেছেন সালাত শেষ করে অর্থ উপার্জন করতে বের হয়ে যাও। অথচ ঠিক পরের আয়াতেই আছে উলটো কথা।
"তারা যখন ব্যবসায় অথবা ক্রীড়া কৌতুক দেখে তখন তারা সেদিকে ছুটে যায় আর তোমাকে রেখে যায় দাঁড়ানো অবস্থায়। বল- ‘আল্লাহর কাছে যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসার চেয়ে উত্তম।’ আর আল্লাহ সর্বাপেক্ষা উত্তম রিযকদাতা।" (সূরা আল জুমুআহ : আয়াত ১১)
অর্থাৎ এটাও দারিদ্র্যতা বিষয়ক রাসূল (সা.)-এর ওই হাদিসের মতো অপব্যাখ্যা।
এরপর তারা বলে–ব্যবসা করব। টাকা কামাব। সেই টাকা ইসলামের জন্য ব্যয় করব। তারা যুক্তি দেখায়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনুল কারিমে জিহাদের জন্য জানের সাথে মাল কথাটা উল্লেখ করেছেন। তাই অর্থ উপার্জন করতে হবে। এটা বলে তারা নিশ্চিন্ত মনে ব্যবসায় মশগুল হয়ে যায়।
কত বড়ো বিভ্রান্তিতে তারা পড়েছে! সুস্পষ্টভাবে শয়তানের ধোঁকা এটা। অথচ কত পরিমান মাল লাগবে সেটা কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেননি। আপনার হাত বা পায়ের একটা আঙ্গুল যদি কম থাকে তখন কি জিহাদ না করার কোনো ওজর আপনার থাকবে? জানের সাথে মাল লাগবে মানে এই না যে, দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে জিহাদে আসো। জানের সাথে মাল কথাটার মানে হচ্ছে, আপনার কাছে যেটুকু আছে সেটুকুই আপনি জিহাদের জন্য বিনিয়োগ করবেন। এটা লাভজনক ব্যবসা। কোনো লোকসান নেই।
অমুক ব্যক্তি জিহাদের জন্য অঢেল সম্পদ বিনিয়োগ করেছেন। তাই বলে কি আপনিও অঢেল সম্পদ না কামানো পর্যন্ত জিহাদের ময়দানে যাবে না? আপনি ধোঁকায় পড়ে আছেন। ওটা তার রিজিক। তাকে তার মহান রিজিকদাতা অঢেল সম্পদের অধিকারী বানিয়েছেন। তাই তিনি জিহাদে তার সম্পদ বিনিয়োগ করতে পেরেছেন। আপনার তাকদীরে যা আছে আপনি শত চেষ্টা করলেও তো তাকদীরে নির্ধারিত অংশের চেয়ে বেশি সম্পদশালী হতে পারবেন না।
তাবুক যুদ্ধের জন্য অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন ছিল। যেহেতু এই যুদ্ধ তৎকালীন পরাশক্তি রোমানদের বিরুদ্ধে ছিল। তাই সাহাবায়ে একরাম (রা.) সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের জন্য অর্থ দান করছিলেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তার সম্পদের অর্ধেকটা নিয়ে এসেছিলেন। বাকি অর্ধেক তার পরিবারের জন্য রেখে এসেছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন এবার হয়তো তিনি আবু বকর আস সিদ্দিককে (রা.) আমলের প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলতে পেরেছেন। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবু বকর আস সিদ্দিক (রা.) তার সম্পদের সম্পূর্ণ অংশ তাবুক যুদ্ধের জন্য দান করে দিয়েছিলেন। আর পরিবারের জন্য বাড়িতে রেখে এসেছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে (সা.)। সুবহানাল্লাহ!
যাইদ ইবনু আসলাম (রহঃ) কর্তৃক তাঁর পিতা থেকে বর্ণিত :
তিনি বলেন, ওমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (তাবূকের যুদ্ধের প্রাক্কালে) আমাদেরকে দান-খায়রাত করার হুকুম করেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই সময় আমার সম্পদও ছিল। আমি (মনে মনে) বললাম, যদি আমি কোনো দিন আবু বাকর (রা.)-কে ডিঙ্গাতে পারি তাহলে আজই সেই সুযোগ। ওমার (রা.) বলেন, আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে এলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমার পরিবার-পরিজনদের জন্য তুমি কি বাকি রেখে এসেছ? আমি বললাম, এর সমপরিমাণ। আর আবু বাকর (রা.) তার সমস্ত মাল নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, হে আবু বাকর! তোমার পরিবার-পরিজনদের জন্য তুমি কি বাকি রেখে এসেছ? তিনি বললেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলকেই রেখে এসেছি। আমি (মনে মনে) বললাম, কখনও আমি কোনো প্রসঙ্গে আবু বাকর (রা.)-কে ডিঙ্গাতে পারব না।
(জামে আত-তিরমিজি : হাদিস নং ৩৬৭৫)
আবু বকরের (রা.) দানের পরিমাণ ওমরের (রা.) দানের পরিমাণের থেকে কম ছিল। তবুও ওমর (রা.) সেদিন আমলের প্রতিযোগিতায় পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে পরবর্তীতে আর কখনোই আবু বকরের (রা.) সাথে প্রতিযোগিতা করবেন না বলে মনস্থির করেছিলেন। কারণ, আনুপাতিকভাবে আল্লাহর জন্য তার ত্যাগ আবু বকরের (রা.) ত্যাগের তুলনায় অর্ধেক। তাই মর্যাদায় আবু বকরের (রা.) দান সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সম্পদের পরিমাণ দেখেন না। তিনি দেখেন ত্যাগের পরিমাণ–তা কি আংশিক, অর্ধেক, নাকি সম্পূর্ণ। কোটিপতি হতে চাওয়া এই পথহারারা পানির মতো সহজ এই কথাটা বুঝেও কেন জানি না বোঝার ভান করে।
চোখের সামনে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলো যেমন আছে। অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক দূর্বল মুসলিম দেশও কিন্তু আছে। কে ইসলামের জন্য কি করেছে আর করতে পেরেছে সেটা কিন্তু এই শতকে এসে একদম পরিষ্কার। সুতরাং আমি আসলে কি চাই সেটা জরুরি। আমার কি কি আছে বা আমার কি কি লাগবে সেটা জরুরি না। সেটা হলো অজুহাত। অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থেকে পালিয়ে দুনিয়ার পেছনে ছুটে চলার জন্য অজুহাত হলো–'অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে' ছবক। অথচ ইসলাম বস্তুগত কোনো শক্তির ওপর নির্ভর করে না। ইসলাম নির্ভর করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাহায্যের ওপর।
অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়াটা পরের আলোচনা। কিভাবে? যে জীবন-মরনের ঝুঁকিতে আছে সে প্রথমে বাঁচতে চাইবে। এরপর বাকি চাহিদা। ইসলাম আজ যে অবস্থায় আছে সেখানে সর্বপ্রথম কাজটা কি 'কোটিপতি হতে হবে' ছবক দানকারীরা তা ভালো করেই জানেন। তাছাড়া কেউ ডোবার পানিতে পড়ে গেলে সেখান থেকে প্রথমে উঠে আসবে। উঠতে সক্ষম না হলে ডোবা থেকে ঠিক ততটুকুই পানি খাবে যতটুকুতে জীবন বাঁচবে। সে কস্মিনকালেও পেট ভরে, আরাম-আয়েশে, নিশ্চিন্তে ডোবার পানি গলধকরন করতে থাকবে না এবং অন্যকেও গলধকরন করার ছবক দেবে না।
লিখেছেনঃ কারিম শাওন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন