সম্প্রতি মিডিয়ায় উঠে আসা ড. আলী রিয়াজ এর নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনায় গুরুত্ব পাওয়া দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR), সংবিধানের আর্টিকেল ৭০-এর পরিবর্তন, এবং সংবিধানে মানবাধিকার কমিশনের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে শুধু অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের বদল ঘটাবে না, বরং আন্তর্জাতিক শক্তি বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করবে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাঃ উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের ভূমিকা
১। উচ্চ কক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং মার্কিন কৌশলঃ
উচ্চ কক্ষ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে গঠিত হলে, এটি ছোট দল এবং স্বাধীন প্রার্থীদের জন্য একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। আইনসভার বাইরে শিল্প বিশেষজ্ঞদেরও মন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকায় গনতন্ত্রের নাম দিয়ে বণিকতন্ত্র (Plutocracy) কায়েম করার রাস্তা উন্মুক্ত হয়ে যায়।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত এই ধরনের পদ্ধতিকে সমর্থন করে, কারণ এটি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়কে মাইনাস করে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী করে। বিশেষত, মানবাধিকার, নারী অধিকার বা সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের দাবিতে মার্কিন যুক্ত সমর্থিত ছোট দল বা সংগঠন উচ্চ কক্ষে প্রবেশ করতে পারবে। কদিন আগেই কিন্তু সারজিস, হাসনাত আব্দুল্লাহদের "জনশক্তি" নামক নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দলের অভ্যুত্থানের আলাপ মিডিয়া পাড়ায় শোনা গিয়েছিল।
২। নিম্ন কক্ষে বিদ্যমান FPTP সিস্টেম এবং মার্কিন প্রভাবঃ
নিম্ন কক্ষে FPTP (First past the post) সিস্টেম বিদ্যমান থাকার অর্থ বিএনপি, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলগুলোর জন্য একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার সহজ সুযোগ। তবে উচ্চ কক্ষে শক্তিশালী বিরোধিতা থাকলে নিম্ন কক্ষের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "ব্যালেন্সড ডেমোক্রেসি"-র নীতি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে
ওয়াশিংটনের নির্দেশে সংবিধানের আর্টিকেল ৭০-এর পরিবর্তনঃ
বিদ্যমান সংবিধানে আর্টিকেল ৭০ বর্তমান সংসদ সদস্যদের তাদের দলীয় অবস্থান থেকে ভিন্ন মত প্রকাশ বা ভোট দেওয়ায় বাধা দেয়। এটি দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে এবং একই সাথে আইনসভায় সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশকে বাধাগ্রস্থ করছে।
আর্টিকেল ৭০ পরিবর্তিত হলে সংসদ সদস্যরা দলীয় বাধ্যবাধকতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে মতামত ও ভোট দিতে পারবে। এতে সংসদের ভেতরে ভিন্ন মত প্রকাশ সহজ হবে, যা রাজনৈতিক বিভক্তি বা দলীয় ভাঙন সৃষ্টি করতে পারে। দেশের রাজনীতিতে নিজের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তিগতভাবে সংসদ সদস্যদের সমর্থন বা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে।আর আমাদের মত দরিদ্র রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের বিক্রি হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুব বেশি প্রভাব খাটাতে হয় না, এটা কে না জানে?
সংবিধানে মানবাধিকার কমিশনের অন্তর্ভুক্তিঃ
মানবাধিকার সংস্থা রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপরে একটি "চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স" ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে নিরপেক্ষ নজরদারি নিশ্চিত করার নাম দিয়ে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হস্তক্ষেপের পথকে সুগম করে।
মানবাধিকার কমিশনকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হলে সুলতানা কামালের মত পশ্চিমা পারপাস সার্ভ করা মানবাধিকার কর্মীদের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে কৃত্রিম মানবাধিকার লংঘনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট করতে পারবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একই সাথে যারা মার্কিন নীতির বিপক্ষে, তাদের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করতে কাজে লাগানো হবে মানবাধিকার সংস্থাকে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর মতো আন্তর্জাতিক ক্রুসেডার সংস্থাগুলো দেশের রাজনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করার বৈধতা পাবে প্রস্তাবিত সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী।
সার্বিক প্রভাব মার্কিন বলয়ে প্রবেশ
১. উচ্চ কক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ছোট দল ও সংস্থা, যেগুলো মার্কিন সমর্থনপুষ্ট, তাদের প্রভাব বাড়বে।
২. সংবিধানের আর্টিকেল ৭০ পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে ভাঙন তৈরি করা সহজ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
৩. মানবাধিকার সংস্থার অন্তর্ভুক্তি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে মার্কিন হস্তক্ষেপ বাড়াবে।
৪. ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি পপুলিস্ট সুশীল-সমাজ কেন্দ্রিক রাজনীতির উত্থান বাংলাদেশকে মার্কিন বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করবে।
৫. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গভীরতর সম্পর্কের ফলে কৌশলগত নির্ভরশীলতা বাড়বে, যা চীনের মতো আঞ্চলিক শক্তির সাথে সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সংশোধিত নতুন সংবিধান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর পরিবর্তন আনবে। এই পরিবর্তনগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধির একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠবে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ওয়াশিংটনের কাছে বন্ধক দিয়ে দেবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, মানব রচিত সংবিধানগুলো আল্লাহর বান্দাদেরকে দুনিয়ার কুফফার-তাগুত গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি করে শেকলে বাঁধা স্বাধীনতার মোহে আচ্ছন্ন করার জন্যই প্রণীত হয়। আর আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তো এজন্যই যে, সে কোনো মাখলুক নয় স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।
[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ অবশ্যই এই তাগুতী সংবিধানের সাথে মুমিনদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে দেশের মানুষের মধ্যে রাজনীতি সচেতনতা তৈরি করে মানব রচিত আইনের শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণের চিত্রটা স্পষ্ট করা উচিত। এর মাধ্যমে উম্মাহর মধ্যে শরীয়াহর চাহিদা তৈরি হবে ইন শা আল্লাহ। ]
লিখেছেনঃ আবু উসামা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন