সিরিয়া বিপ্লবের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ | পর্ব ৫

 

বাশার আল-আসাদের গোত্র নুসাইরী-শিয়ারা আসলে কারা?
আপনারা জানেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত কিংবা অটোমান এ্যাম্পায়ারকে পরাজিত করার পর, ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালি আর রাশিয়া মিলে সাইকস-পিকট চুক্তির মাধ্যমে সালতানাতের বিভিন্ন অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

তখন বর্তমান সিরিয়া এবং লেবাননটা ফ্রান্স পায়। ব্রিটিশরা পায় ফালিস্তিন, জর্ডান, ইরাক এই অংশটা। রাশিয়া পায় চেচনিয়া, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, আজারবাইজান ওই অংশটা। ইতালি পায় তুর্কির তথা আনাতোলিয়ার দক্ষিণ অংশটা। অনেকগুলো অংশ অবশ্য তুর্কি পুনঃউদ্ধার করে আধুনি তুর্কি রাষ্ট্র গঠন করলেও, আশ-শাম, ইরাক এগুলো উপনিবেশী শক্তি হাতেই রয়ে যায়।
তো সিরিয়াতে ফ্রান্সের দরকার ছিল স্থানীয় দালাল শক্তি, যারা তাদের হয়ে কাজ করবে শাসন করবে। নুসাইরী শিয়ারা হচ্ছে সেই গোষ্ঠি যারা ফ্রান্সের দালালিতে নিযুক্ত হয়েছিল।

কিন্তু কেনো? নুসাইরী হলো শিয়াদের একটা এক্সট্রিম শাখা যারা আলী (রা) কে আল্লাহর সিফাত দিয়ে দেয়।

এরা নিজেদেরকে আলাউই-ও বলে। কিন্তু আগে থেকেই ছিল ডাকাত, বর্বর শ্রেণীর লোকজন। এরা ছিল খিলাফত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, যাযাবর টাইপের। তো এদের দিয়ে ফ্রেঞ্চরা (ফ্রান্স) স্থানীয় সেনাবাহিনী গঠন করে। এবং স্বাধীনতার পরও সিরিয়ান সেনাবাহিনীতে তাদের ব্যাপক আধিপত্য ছিল।

এবং বাশার আল-আসাদের বাপ হাফিজ আল-আসাদ এই নুসাইরীদের সাপোর্টে, এবং বাথ পার্টির সাপোর্টে ক্ষমতায় এসে সিরিয়াকে সোস্যালিস্ট সেক্যুলার রিপাবলিক ঘোষণা করে (সমাজতান্ত্রিক ধর্মহীন প্রজাতন্ত্র)। মাঝে দিয়ে সিরিয়া আর মিশর কিন্তু ফেডারেশন স্টেট গঠন করেছিল ইজরায়েলকে শান্ত করতে আরব জাতীয়তাবাদী বাথ পার্টির আদর্শে। কিন্তু তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মিশরের জামাল আবদেল নাসের, গাদ্দাফি, সাদ্দাম, ইয়াসির আরাফাত, ভুট্টো এরা সকলে ছিল বাথ পার্টি কিংবা এটার দ্বারা প্রভাবিত লোকজন। তারা সোস্যালিস্ট সেক্যুলার এবং আরব ন্যাশেনালিস্ট আইডিয়া রাখতো। এবং মুসলিম ব্রাদারহুড লোকালি এই সেক্যুলার সোস্যালিস্ট বাথ পার্টির সাথেই আইডিওলজিকাল স্ট্রাগলের (ভাবাদর্শগত/মতাদর্শগত সংগ্রামের) মুখোমুখি হয়েছিল।

বাহিরের বিশ্বে কিন্তু তারা ইজরায়েল বিরোধী মুসলিম বিশ্বের কান্ডারী। কিছুটা ইসলামী ভাইব, কিছুটা আরব জাতীয়তাবাদ এগুলো মিশলে এক একজন হিরো। অথচ এরা নিজ দেশে ইসলামিস্টদের উপর গণহত্যা চালায় আর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একটু আধটু যুদ্ধ করে মাঠ ছেড়ে পালায়। তখন বাংলাদেশেও সোস্যালিস্ট মেন্টালিটি অ্যাটাক ফেনোমেনমন (Phenomenon/ঘটমান বিষয়) হয়ে দাড়িয়েছিল - এমনকি ইসলামিস্ট, সোস্যালিস্টও এখনকার ডেমোক্রেটিক ইসলামিস্টের মত।

তখন ব্রাদারহুডের সাথে সৌদীর ভালো সম্পর্ক, কিন্তু বাথ পার্টির সাথে বিরোধ। একটা সময় ইরানের উত্থান হলোো। বাথ পার্টিও জৌলুশ হারিয়ে বার্থ হতে লাগলো। এই পার্টির স্বৈরশাসকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, এমনকি একে অপরেরে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলো, যেমন ৯০ এর দশকের গালফ ওয়ারে সিরিয়ার হাফিজ আল-আসাদ আমেরিকার সাথে মিলে সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। অথচ উভয়ই বাথ পার্টির।

ইরানের উত্থানের পর তারা বাথিসম বাদ দিয়ে আবারও পুরোনো শিয়াইসমের মাধ্যমে ইরানের সাথে সম্পর্ক তৈরী হলো। এটা হলো আশির দশকের কথা। তখন হিজবুল্লাহ তৈরী করা হলো পিওর শিয়া মিলিশিয়া হিসেবে। আরেকদিকে তৎকালীন মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর নির্যাতন তো ছিলই। যেটা এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। এমনকি ব্রাদারহুড নেতারা এদের হাত থেকে রেহাই পেতে খোমেনীর কাছে সাহায্য চাইলেও খোমেনী সাহায্যের নামে উল্টো তাদের ধরিয়ে দেয়, ফাঁসিয়ে দেয় - এমনও কথিত আছে।

তখন একটা চুক্তির মত হয়েছিল যে, একটা অংশ ইসলামিস্টদের জন্য ছেড়ে দিবে, সম্ভবত হামা। যেখানে ইসলামিস্টরা শরীয়াহ অনুযায়ী শাসন করবে। এতে ইসলামিস্টরা খুশি হয়ে সবাই সেখানে জড়ো হয়। সব যখন গুছাতে ব্যাস্ত তখন হঠাৎ একদিন আসাদ বাহিনী চারদিকে থেকে আক্রমন করে গণহত্যা চালায়। এরপর তো ইসলামপন্থীদের কোমর ভেঙে পড়ে। মুজাহিদদের অনেকে আফগানিস্তানে চলে আসে। গ্লোবাল জিহাদের আর্কিটেকচার খ্যাত আবু মুসাব আস-সুরী এখান থেকেই উঠে আসেন।

তারপর আফগানিস্তানে রাশিয়ার পরাজয়ের পর তো ওইসব রাশিয়াপন্থী স্বৈরশাসকরা আমেরিকার দালালী শুরু করে। তখন আল-কায়দা গঠিত হতে থাকে সারা বিশ্বের বিভিন্ন গ্রুপের মুজাহিদ নেতাদের নিয়ে। তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত হয় যে, এইসব স্বৈরশাসক, সেক্যুলার শাসক তারা মূলত ওয়েস্টের (পশ্চিমা) পুতুল। আমরা যতবারই যতভাবেই তাদের পরাজিত করি না কেন, পরবর্তিতে ওয়েস্ট কোন না কোনভাবে তাদের একটা পুতুলকে বসাবেই। এই যে পুতুল বসানোর সক্ষমতা এটা যদি আমরা বন্ধ করতে না পারি, হাসিনার পর ইউনুস আসবে, ইউনুসের পর ডারত না হোক, এমন কাউকে আসতে হবে যে আমেরিকা সমর্থিত হবে। যে আমেরিকান এ্যাসেটগুলোকে প্রোটেক্ট (আমেরিকার পা চাটাদের রক্ষা) করবে, তাদের এক্সপ্লয়েটশন (শোষণ), ইনজেকশনের (অবৈধ অনুশাসন) বাঁধা দিবে না।

আর যদি আমেরিকার সেই সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন স্থানীয়ভাবে যদি ইসলামিস্টরা ক্ষমতা পায় সেটা টেকসই হবে। এবং এটা আরব বিশ্বের খুব দরকার, নতুবা ইজরায়েলকে সাইজ করার মত লঞ্চপ্যাড পাওয়া যাবে না। পাপেটরা সেক্যুলার হোক কিংবা শুধু ন্যাশনালিস্ট (জাতীয়তাবাদী) তারা তাদের দুনিয়াবী ইন্টারেস্টের কারণে খুব সল্প মূল্যে আপোষ করে ফেলবে, এতদিন করে আসছে। আপোষহীন ইসলামিস্ট স্টাবলিসমেন্ট (সংস্থা/প্রতিষ্ঠান) সিরিয়া, মিশর কিংবা জর্ডানে থাকলে ইজরায়েলের জন্য টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি তুর্কি, সাউদী, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ইয়েমেনও। কারণ জলসীমা (সমুদ্র পথে) অবরোধ করার জন্য খুব গুরত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে ইয়েমেন।

হাফিজ আল-আসাদের পর, তার ছেলে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসে। ১০ বছর শাসনও করে তথাকথিত আধুনিক রাষ্ট্র সিরিয়া টেকনিক্যালি ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসনে ইরানের মত আমেরিকার পক্ষেই ছিল। কারণ আমেরিকা শিয়াদের বিরুদ্ধে চুপ ছিল, রাশিয়াও এজন্য চুপ ছিল। শুধু ইজরায়েলের চাপে এবং পারমাণবিক বোমা তৈরীর বিরুদ্ধে আমেরিকা ইরানকে চাপ দিচ্ছিল।
এরপর গত দশকে আরব বসন্তের ধাক্কায়, সিরিয়াতেও সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় যে, এক স্বৈরশাসকের অধীনে আর কতদিন? বেশীরভাগ সম্পদ সংখ্যালঘু নুসাইরী শিয়া গোষ্ঠিদের হাতে। প্রশাসন, আর্মিতে সব শিয়া আধিপত্য। এরপর আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আসাদ মিলিটারী এ্যাকশনে গেলে আর্মির সুন্নী অংশটা বের হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কখনো বিদ্রোহীরা কিছু শহর দখল করে নেয়। আবার তাদের থেকে ইরান-রাশিয়ার সহায়তায় আসাদ সেগুলোর পুনঃদখল করে। বিদ্রোহীরা পিছিয়ে আছে, কারণ তাদের এয়ার সাপোর্ট নেই।

যদিও তাদের সাপোর্টে আমেরিকা, তুর্কি, সৌদী, কাতার, আরব আমিরাত ছিল। কিন্তু আমেরিকা আসাদের সাথে সমঝোতায় যাওয়ার পর আরব আমিরাত এখন বাশারের পক্ষে। সৌদী নিরপেক্ষ এবং তুর্কি-কাতার বিরুদ্ধে থেকেও কিছুটা ডিপ্লোমেসী (কূটনীতি) করে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করেছে বিদ্রোহীদের। এর মাঝে আইসিসের (ISIS) বাড়াবাড়ির কারণে বিদ্রোহীরা দামস্কাসের কাছে গিয়েও আবার পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। এরপর আল-কায়দা গ্লোবাল ইকোসিস্টেমে থাকা না থাকা নিয়ে বিদ্রোহীদের মতপার্থক্য হওয়ায়, আল-কায়দা সেখানে নেতৃত্বের পজিশনে যেতে না পারলেও তাদের ইনফ্লুয়েন্স কিছুটা হলেও বজায় রেখেছে, যেমন বিদ্রোহীরা শরীয়াহ শাসনের জন্যই যুদ্ধ করছে। আমেরিকা সমর্থিত কিছু সেক্যুলার গোষ্ঠি আছে, আবার তুর্কি সমর্থিত কিছুটা গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠিও আছে। কিন্তু মোটাদাগে বিদ্রোহীদের তুর্কি সমর্থন দিচ্ছে কারণ তুর্কি ছেড়ে দিলে, আল-কায়দা আবারো শক্তিশালী পজিশনে চলে যাবে।

লিখেছেনঃ Bearded Bengali

ফুটনোটঃ
আল্লাহর সিফাত-  https://www.alkawsar.com/bn/article/3410/‌

https://www.alkawsar.com/bn/article/3479/     https://tinyurl.com/yc7t38s6 ]

সাইকস-পিকট চুক্তি (Sykes–Picot Agreement)- https://tinyurl.com/5yjs5288
 

নুসাইরিয়া একটি ভ্রান্ত সম্প্রদায়- https://tinyurl.com/3s5p9b5h
বাথ পার্টি- https://tinyurl.com/3xs6b83k
গালফ ওয়ারে (Gulf War)- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gulf_War

আবু মুসাব আস-সুরী-
পরিচয়- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mustafa_Setmariam_Nasar
নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত, আলোচনা.....- https://gazwah.net/?cat=451

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন