মহাসংকট যখন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে

 


মহাসংকট যখন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে, তখন ব্যক্তিগত আবেগগুলোকে একপাশে রেখে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। এই জীবনটা একবারের জন্য না। আরো একটা জীবন আছে। প্রথম ও ক্ষনস্থায়ী জীবনটা মানুষের জন্য। দ্বিতীয় ও চিরস্থায়ী জীবনটা কেবল নিজের জন্য।


মানুষ মহামানব হয়ে ওঠে যখন সে অন্য মানুষকে রক্ষা করার জন্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে। কারণ, নিজেকে বিলিয়ে দিতে হলে রক্ত-মাংসে গড়া এই দেহের বাধাকে উতরাতে হয়। এই দেহ একটা ভোগের খাঁচা। এই খাঁচা থেকে আমার আমিকে মুক্ত করে আনতে হয়। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার এই পৃথিবীতে তাই সবাই মহামানব হতে পারে না। কারণ, তারা মহামানব হতে চায় না। হয়তো তারা দ্বিতীয় জীবনকে বিশ্বাসই করে না।


আমার জীবনের একটা মটিভ আছে। আমার ফিলোসফি হচ্ছে–আমি পৃথিবীতে এসেছি ভালো মানুষগুলোকে ভালোবাসতে আর খারাপ মানুষগুলোকে শাস্তি দিতে। কত বড়ো একটা কথা বলে ফেললাম! আমার কথা শুনে মনে হতে পারে আমি নিজেকে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, নিরপরাধ একটা ফেরেশতা ভাবছি। না। ব্যাপারটা আসলে তা না।


এক ধরণের অপরাধ আছে যেটা কেবল অপরাধীর ব্যক্তি জীবনকেই প্রভাবিত করে। আরেক ধরণের অপরাধের দ্বারা অপরাধী অন্যের অধিকারকে বিনষ্ট করে। আমি প্রথম ধরণের অপরাধটা হয়তো করি। কিন্তু দ্বিতীয় ধরণের অপরাধ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকি।


পৃথিবীতে যত যুদ্ধ সব এই দ্বিতীয় ধরণের অপরাধের কারণে সংগঠিত হয়। সমস্যা মানুষ তৈরি করে। তাই সেটা সমাধান করার জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এটাও একটা সমস্যা। নিজেকে নিশ্চিত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানসিকতা লালন করা মানুষের সংখ্যা খুব কম। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে ভালো রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অথচ ওদিকে অত্যাচারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের অপরাধ অব্যহত রেখেছে।


এই মহৎ কাজের প্রথম পূর্বশর্ত হলো–লোভকে সংবরণ করতে হবে। লোভ একটা দ্রতগামী ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মতো। এটার মুখে লাগাম টেনে দিতে হয়। দ্বিতীয় পূর্বশর্ত হলো–প্রিয়জনের মায়া কাটিয়ে উঠতে হয়। পিছুটানকে উপেক্ষা করতে হয়। ভালোবাসার আবেগগুলোকে তালাবদ্ধ করতে হয়। লোভ, মায়া, ভালোবাসা, আবেগ; এ সবই সাড়ে তিন হাত দেহের ভোগ।


তাই এটা বেশ কষ্টসাধ্য একটা কাজ। অনেকটা সাধনার মতো। একদিনে বা কয়েক বছরেও এই সাধনা শেষ হয় না। তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়–যার ওপরটা পাথর; কিন্তু সেই পাথরের ফাটল থেকেই নির্মল পানির ঝর্না বের হয়।


মনকে প্রস্তুত করতে পারলে পাখির মতো দুটো পাখা গজাবে। অদৃশ্য দুটো পাখা। নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হবে। যেই পাখি পার্থিব কিছু চাওয়া-পাওয়ার শিকলে বন্দি ছিল।


পরের কাজটুকু সহজ। পাখিটা ঠোঁটে পাথরের টুকরো নিয়ে অপরাধীদের বিনাশ করতে উড়ে যাচ্ছে। শত্রুকে নিজের ক্ষুদ্র সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আঘাত করল। কোনো এক শত্রুর আঘাতে সে দ্বিতীয় জীবনে প্রবেশ করেছে।


এবার সে বিমূর্ত এক পাখি! ডানা, পালক, ঠোঁট; সবই যেন মায়াবি এক আলো আর ধোঁয়া দিয়ে তৈরি। অপরাধী নামক আগাছা সমূলে নির্মূল হবে একদিন। তখন ঠোঁটে শান্তির প্রতীক এক টুকরো সবুজ পাতা নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে উড়ে বেড়াবে। এ ডাল থেকে ও ডালে। ঝরনার ধারে। কোনো পাহাড়ের চূড়ায়। মেঘেদের সাথে। এই মুক্ত আকাশের পুরোটাই এখন তার।


লিখেছেনঃ কারিম শাওন 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন