ফাহামদের আসল উদ্দেশ্য

 

"ইসলামপন্থিদের উদ্দেশ্যে বলছি, ‘আপনাদের শত্রুর শত্রু আপনাদের বন্ধু’–এটা চিরন্তন সত্য নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এর ধরন বদলায়। আপনাদের শত্রুর শত্রু আপনাদেরও শত্রু হতে পারে; এমনকি আরও বড়ো শত্রু হতে পারে। এমতাবস্থায় প্রতিপক্ষ হিসেবে আপনারা যদি উভয় শত্রুর তুলনায় দুর্বল হন, তাহলে এর ফলাফল দাঁড়ায়–লড়াইয়ের মাঠে আপনারা একটা বল। দু-পক্ষই আপনাদেরকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করবে। ভাগে পেয়ে গেলে নিজেদের মতো ব্যবহার করবে। সুযোগ বুঝে আপনাদের বুকে লাথি দিয়ে আপনাদের অপর পক্ষের জালে পাঠানোর মাধ্যমে অপর পক্ষকে ঘায়েল করবে।


উদাহরণটা অন্যভাবে দিলেঃ

আপনারা একটা লাঠি। লাঠিটা মাঝখানে। দু-পাশে দুটো প্রতিপক্ষ। দু-পক্ষই সুযোগে আছে লাঠিটা যেকোনো উপায়ে দখলে নেওয়ার। যে-ই লাঠিটা আগে নিতে পারবে, সাথে সাথে প্রতিপক্ষের মাথায় বাড়ি বসিয়ে দেবে।

এরপর? এরপর আর কী, ব্যবহৃত পুরোনো রুমালের মতো আপনাদেরকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে।


অর্থাৎ, জঙ্গলে যাবেন আপনারা, ঝোপ কাটবেন আপনারা, সাপের গর্তে হাত দেবেন আপনারা, সাপের কামড় খাবেন আপনারা, বিষে নীল হয়ে মারা যাবেন আপনারা; সবই করবেন আপনারা, মাঝখান থেকে লাভবান হবে যেই শত্রুপক্ষটা আপনাদেরকে বাগে নিতে পেরেছিল।


গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মাধ্যমে কোনো শাসককে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে হয়। গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব সাধারণ কোনো মিছিল বা আন্দোলন বা অনশন না। বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানে রক্ত ও প্রাণ দেওয়া লাগে। ‘রক্ত ও প্রাণ দিয়ে হলেও এই শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করবই’–এ প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠী রাজপথে নামে। হাতে অস্ত্রও তুলে নিতে হয়।


বর্তমান আওয়ামী লীগ এমন একটা শক্তিশালী দলে পরিণত হয়েছে–যাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে ছোটোখাটো মিছিল বা আন্দোলনে কাজ হবে না। গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব ঘটাতে হবে। এমনকি আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারত প্রাথমিক পর্যায়ে সরাসরি বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করবে না। তারা প্রথমে বিভিন্ন রকম কূটচাল চেলে বাংলাদেশিদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে।


 এরপর বলবে–তোমরা মাঠে নামো। আমরা তোমাদের সাথে আছি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মাঠে নামবে। আওয়ামী লীগ বডি লাইন গুলি করে হত্যা করবে। সাধারণ মানুষ আরও ক্ষেপে যাবে। এরপর নিরুপায় হয়ে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপকে বলবে–আমাদেরকে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরশাসক থেকে মুক্ত করো। ব্যস! কেল্লা ফতে। আমেরিকা, ইউরোপ তো এই অপেক্ষায়ই বসে ছিল। বিড়ালের মতো শুধু মাথাটা ঢোকাতে পারলেই চলে; বাকি শরীরটাও একসময় ঢুকিয়ে দেবে। ওরা অধিকাংশ বাংলাদেশিদের সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশে নিজেদের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করবে। সাথে থাকবে ভারতের সেনাবাহিনী। মুখে থাকবে ‘বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করতে এসেছি’; অন্তরে থাকবে ‘চীনকে মোকাবিলা করতে এসেছি’। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এতে বাধা দেবে। শুরু হবে যুদ্ধ। এভাবে বাংলাদেশটা আফগানিস্তান-ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়ায় পরিণত হবে।


কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে মাঠে নেমে রক্ত ও প্রাণ দেওয়ার কাজটা কারা করবে? বর্তমান বিএনপি? বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল? উঁহু। বিশটা বিএনপি এবং সকল রাজনৈতিক দল একত্রে হলেও গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম নয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে আশ্রয়ে থেকে যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তারাও বিএনপি ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে নানান কর্মসূচি, অমুক-তমুক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও, মাঠে নেমে রক্ত ও প্রাণ কেউই দেবে না। কারণ, তাদের সেই সাহস, শক্তি, লোকবল ও চেতনা নেই।


তাহলে হাতে উপায় একটাই।

 যেকোনোভাবে ইসলামপন্থিদের রাজপথে নামিয়ে গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব ঘটানো। কারণ, ইসলামপন্থিরা সাহসী ও নির্লোভ। তারা সংখ্যায় অনেক। তাদের দুনিয়াপ্রীতি নেই।


  ইসলামের জন্য রক্ত দেওয়ার মতো চেতনা তারা লালন করে। ওদের শুধু এটাই দরকার। কারণ, ওরা সাপ মারবে, কিন্তু নিজেরা গর্তে হাত দেবে না। অন্যদের দিয়ে গর্তে হাত দেওয়াবে। এতে উভয় দিকেই লাভ। শত্রু হিসেবে বড়ো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা গেল। পাশাপাশি ইসলামপন্থিদের মতো ‘ছোটো তবে ভীষণ ঝাল’ মরিচগুলোকেও শেষ করা গেল। 

এটাকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার বলে না। এটাকে বলে কোনো ঢিল না ছুড়েই দুটো পাখি শিকার। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা প্রবাদটার মতো।


অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন পক্ষ ও ক্ষমতাহীন পক্ষ–উভয়ে একই মতাদর্শের অনুসারী। ক্ষমতাহীনরা ক্ষমতাসীনদের ঘায়েল করতে ব্যবহার করবে উভয়ের চিরশত্রু ইসলামপন্থিদের। রক্ত ও প্রাণ দিয়ে এক দানবের মোকাবিলা করবে ইসলামপন্থিরা, আর কার্য হাসিল হওয়ার পর ইসলামপন্থিদের কাঁচকলা দেখিয়ে পুরো গুড়টা খাবে নতুন আরেক দানব।


এজন্যই দেখবেন–আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতপন্থি বাম নাস্তিকরাও ইসলামের পক্ষে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাঙালি মুসলমানদের মন জোগানোর চেষ্টা করছে এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলে সরকার পতনের আন্দোলনের উসকানি দিচ্ছে। আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতকে মোকাবিলা করতে এই একই চাল চেলে আওয়ামী লীগ নিজেও কিন্তু ইসলামিক জোব্বা গায়ে দিয়েছে।


বিষয়টাকে একটু বিস্তারিতভাবে না বললেই নয়। মাঝে মাঝে দেখা যায়, ইসলামিক কোনো ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের মুসলিমদের শাহবাগী বামদের একটা অংশ কটাক্ষ করলে শাহবাগী বামদের অপর অংশটা মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে কটাক্ষকারী শাহবাগী বামদের ধুয়ে দেয়।


কটাক্ষকারী শাহবাগী বামরা হলো–কট্টর ও চরমপন্থি বাম, ইসলামবিদ্বেষী, চরমপন্থি সেক্যুলার, হিন্দুত্ববাদের ঘেটুপুত্র, বেকুব। এদের জ্ঞানের আওয়াজের চেয়ে গলার আওয়াজ বেশি। এককথায়, এরা হলো থার্ডক্লাস বাম। বাংলাদেশে এদের আরেক নাম কলাবিজ্ঞানী। একে তো বেকুব হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মুসলমানদের ঘিরে চতুর বামদের কঠিন চাল এরা ধরতে পারে না; দ্বিতীয়ত, কট্টর বাম (পড়ুন ইসলামবিদ্বেষী) ও হিন্দুত্ববাদের ঘেটুপুত্র হওয়ার কারণে মুসলিমদের কোনো কাজকেই এরা সহ্য করতে পারে না। এই দলে আমেরিকা ও ভারতপন্থি বাম আছে, আবার আওয়ামীপন্থি বামও আছে। কিছু পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেলও আছে।


চতুর শাহবাগী বামরা হলো–উদার বাম, নরমপন্থি সেক্যুলার, বুদ্ধিমান। বামদের এই অংশটা জ্ঞানী। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনা খুব সূক্ষ্ম ও দীর্ঘমেয়াদি। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এই দেশের মুসলিমদের ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। তারা একেবারে গভীর থেকে ক্ষয় করবে। শিকড় নষ্ট করে দেবে; কোনো হাউকাউ করে বা কটু বাক্য দিয়ে না, মুখের মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে। সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবে। বাঙালি মুসলমান আবেগী জাতি। চতুর বামরা এই আবেগটাকে নিয়েই খেলবে। এই দলে আমেরিকা ও ভারতপন্থি বাম আছে, আবার আওয়ামীপন্থি বামও আছে। কিছু পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেলও আছে।


অর্থাৎ, শাহবাগী বাম নাস্তিক দুই প্রকার। এই দুই প্রকারের মধ্যে আছে আরও দুটো ভাগ।


১. আওয়ামীপন্থি শাহবাগী বামঃ


ক) চরমপন্থি শাহবাগী বাম

খ) চতুর শাহবাগী বাম


২. আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতপন্থি শাহবাগী বামঃ


ক) চরমপন্থি শাহবাগী বাম

খ) চতুর শাহবাগী বাম


চতুর শাহবাগী বামদের এই অংশটা খুব বুদ্ধিমান। এই অংশটা জানে যে, মডারেট মুসলিম মানে বিড়াল। মূলধারার ইসলামের সাথে মডারেট মুসলিমদের যোজন যোজন দূরত্ব। সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ৯০% আইনকানুন-রীতিনীতি-প্রথা মডারেট মুসলিমরা সেচ্ছায়ই পালন করে৷ তারা রোজা-নামাজ করে, হজ-কুরবানি করে। অন্যদিকে আবার পূজায় যায়, দিবস উদ্‌যাপন করে, বড়দিনে শুভেচ্ছা জানায়, পহেলা বৈশাখে যায়, বিয়েশাদিতে মদটদ খেয়ে নাচগান করে, বেপর্দা নাটক-সিনেমা-গানবদ্য দেখে, কখনো পর্দা করে কখনো বেপর্দা হয়ে বের হয়, মাহরাম-গায়রে মাহরাম মানার ধারেকাছে নেই ইত্যাদি লম্বা ফিরিস্তি। এ রকম মডারেট মুসলিমদের সাথে ওই চতুর বামদের কোনো সংঘর্ষ নেই; বরং সেক্যুলাররা তো এটাই চাই। কারণ, এটাই তো সেক্যুলারিজম।


আগেও বলেছি, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান মডারেট মুসলিম এবং আমেরিকা ও ভারতবিরোধী। তো, চতুর বামরা


(১.খ) নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে এ রকম রেডিমেড একটা জনগোষ্ঠীকে কায়দা মতো কবজায় নিয়ে আমেরিকা ও ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা ও ভারতকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করার এই সুযোগ তারা কেন হাতছাড়া করবে? তা ছাড়া আমেরিকা ও ভারতকে মোকাবিলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানকে নিজেদের পক্ষে রেখে দল ভারী করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্যই দেখবেন, ড. সলিমুল্লাহ খান বাঙালি মুসলমানদের ব্যাপারে আগে ছিল বেশ গরম, তবে এখন অনেকটা নরম। সে একদিন শাহরিয়ার কবিরকে ওয়াশ করে, আরেক দিন সে হুমায়ুন আজাদকে ওয়াশ করে। পশ্চিমাদের সমালোচনায় সে মুখোর।


একইভাবে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান মডারেট মুসলিম এবং আওয়ামী লীগবিরোধী। তো, চতুর বামরা (২.খ) নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে এ রকম রেডিমেড একটা জনগোষ্ঠীকে কায়দা মতো কবজায় নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার এই সুযোগ তারা কেন হাতছাড়া করবে? তা ছাড়া আওয়ামী লীগকে মোকাবিলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানকে নিজেদের পক্ষে রেখে দল ভারী করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্যই দেখবেন, পিনাকী ভট্টাচার্য মুসলিমদের মুখপাত্রের মতো কথা বলে। কখনো জাফর ইকবালকে ধুয়ে দেয়। কখনো সিপিবিকে ধুয়ে দেয়। কখনো-বা মোদিকে ধুয়ে দেয়।


তবে, যেহেতু আওয়ামী লীগ নাস্তিকদেরকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এতদিনে নিজেকে সুগার কোটিং করে বাংলাদেশের মুসলমানের কাছে ভালো সেজে ফেলেছে, আর বাংলাদেশের মুসলমানরা আওয়ামী লীগের চেয়ে আমেরিকা ও ভারতকে বেশি ঘৃণা করে, তাই আমেরিকাপন্থি চতুর বামরা (২.খ) ইসলামপন্থিদের নিজেদের কবজায় নেওয়া ব্যাপারে একটু বেশি সরব। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশির সমর্থন নিতে হলে তাদের হাতে এ ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই।


আরেকটা বিষয় হলো, আওয়ামীপন্থি চতুর বামদের (১.খ) সাথে আবার আমেরিকাপন্থি চতুর বামদের (২.খ) সম্পর্ক এক্কেবারে খারাপ। খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, তারা দুটো বিপরীত পক্ষের হয়ে মাঠে নেমেছে। উদ্দেশ্য অপর পক্ষকে কুপোকাত করা।


আমেরিকাপন্থি চতুর বামদের সব আশার গুড়ে বালি দিয়ে দেয় আওয়ামীপন্থি ও আমেরিকাপন্থি চরমপন্থি বামরা। আমেরিকাপন্থি চতুর বামেরা ইসলামের পক্ষে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, পিঠে হাত বুলিয়ে, তেলটেল মেরে, মডারেট মুসলিমদের যেই না একটু দলে ভেড়ায়, ওমনি উভয়পন্থি চরমপন্থি বামরা হঠাৎ একটা ইস্যু তুলে ইসলামের প্রতি নোংরা মন্তব্য, কটুকথা, ঘৃণা-বাক্য ছড়িয়ে মডারেট মুসলিম সহ গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ সেক্যুলারগোষ্ঠীর বিপক্ষে ক্ষেপিয়ে তোলে। কারণ, সাধারণ মানুষ তো অতশত বোঝে না যে–কে আওয়ামীপন্থি শাহবাগী বাম আর কে আমেরিকাপন্থি শাহবাগী বাম। শাহবাগী বামরা যে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে সেই কবে। সেটা বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমান ঠাহরই করতে পারেনি। তাই, কোনো এক শাহবাগী বাম ইসলাম নিয়ে কটু কথা বললে সেই দায় সব শাহবাগী বামদের গায়ের ওপর পড়ে যায়।


এতে করে বেশি লোকসান হয় আমেরিকাপন্থি বামদের। কারণ, যেহেতু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করার ফলে আওয়ামী লীগের ওপর বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই ক্ষেপা, তাই আমেরিকাপন্থি চতুর বামরা আওয়ামীপন্থি চতুর বামদের তুলনায় সাধারণ বাংলাদেশিদেরকে নিজেদের পক্ষে বেশি কাজে লাগাতে পারবে এবং পারছেও। আওয়ামী লীগ এসব ভালো করেই বোঝে। তাই মাঝে মাঝে আওয়ামী লীগ ইচ্ছেকৃতভাবে আওয়ামীপন্থি চরমপন্থি শাহবাগী বামদের দিয়ে ইসলামের বিপক্ষে ঘৃণা বাক্য ছড়ায়; যেন ইসলামপন্থিদের সাথে সকল বামদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে ইসলামপন্থিরা ইসলামের প্রতি ভালোবাসা থেকে কোনো বামদের সাথেই আর একত্র হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন করতে নামবে না।


উপরন্তু, মুসলমানের রক্তে মাখা হাতটা ধুয়ে-মুছে নিজেকে সুগার কোটিং করে ইসলামি জোব্বা তো আওয়ামী লীগও গায়ে দিয়েছে। ফলে দেখা যায়, আমেরিকাপন্থি চতুর বামরা যেই ফলটা খাবে বলে আশা করে রেখেছিল, সেই ফলটা আওয়ামী লীগ খেয়ে নেয়। এভাবে চলতে থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান নামক গোটা গাছটাই আওয়ামী লীগ একদিন সাবাড় করে দেবে।


ঘটনার রহস্যজনক টুইস্ট কিন্তু এখানে। বাম নাস্তিকদের দুটো পক্ষই কিন্তু শাহবাগের ফুট সোলজার ছিল। অথচ আমেরিকাপন্থি চতুর শাহবাগী বামরা এখন চরমপন্থি বামদের ‘শাহবাগী’ বলে গালি দেয়। তারা মায়াকান্না জুড়ে দিয়ে বলে–শাহবাগে যাওয়া তাদের ভুল ছিল। সেদিন শাহবাগে না গেলে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জন্ম হতো না। রাষ্ট্রের বিচারিক ও প্রশাসনিক ইনস্টিটিউটগুলো তথা রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংস হতো না। তাই তারা অনুশোচনাভরে শাহবাগ থেকে ফিরে এসেছে।


অথচ বাস্তবতা হলো, এদের এসব কথা পুরোটাই ধোঁকা। ‘শাহবাগ কী’, সেটা আমেরিকাপন্থি শাহবাগীসহ সকল শাহবাগীই ভালো করে জানত। শাহবাগ তৈরি না হলেও আওয়ামী লীগ এখনকার মতোই একটা দানবে পরিণত হতো। কারণ, ফাঁসি দেওয়া জামায়াতের নেতা মানেই বাংলাদেশের রাজনীতির সমগ্র ময়দান নয়। জামায়াত মানেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ইনস্টিটিউট নয়। আসল ব্যাপারটা হলো, তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাচ্ছে। তারা অন্তরে এক রকমের উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করছে, আর ইসলামপন্থিদের সামনে প্রকাশ করছে ভিন্ন রকমের উদ্দেশ্য।


ভারতের প্রত্যক্ষ ইশরায় পরিচালিত শাহবাগ ধীরে ধীরে একটা নৈরাজ্যবাদী দল হয়ে উঠেছিল। শাহবাগীরা নিজেদেরকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেয়েও বড়ো কিছু ভাবতে শুরু করেছিল। তাই ওরা একের পর এক কর্মসূচি দিত। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের কী করা উচিত আর কী করা উচিত না, সেই ব্যাপারে ওরা দিকনির্দেশনা দেওয়া শুরু করেছিল। যেই উদ্দেশ্যে শাহবাগীরা প্রথম দিন শাহবাগে এসেছিল, একসময় সেই উদ্দেশ্য একেবারে গৌণ হয়ে গেল। অর্থাৎ, ওপরে অরাজনৈতিক জামা পরে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে দিয়েছিল। বিশেষ করে শাহবাগীদের চার ভাগের তিন ভাগই আমেরিকা ও ভারতপন্থি। ফলে শাহবাগী বাম নাস্তিকরা একসময় আওয়ামী লীগের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


আওয়ামী লীগ শাহবাগীদের যতদিন পর্যন্ত গুড় খাইয়েছে, ততদিন আওয়ামী লীগ ওদের কাছে ভালো ছিল। যেদিন গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিলো, সেদিন ওদের কাছে আওয়ামী লীগ একটু খারাপ হলো। পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও করতে গিয়ে যখন পুলিশের হাতে প্যাঁদানি খেল, সেদিন ওদের কাছে আওয়ামী লীগ আরও একটু খারাপ হলো। এরপর ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের সময়টাজুড়ে আওয়ামী লীগ ইসলামপন্থিদের সাথে একটু একটু করে ঘেঁষতে থাকে, আর শাহবাগীদের কাছে আওয়ামী লীগ একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে। শেষমেশ ২০১৬ সালের পহেলা বৈশাখের সংবাদ সম্মেলনে নাস্তিকদের বিপক্ষে শেখ হাসিনার ওই মন্তব্যটা শুনে আমেরিকাপন্থি শাহবাগীরা ব্যাপক ক্ষেপে যায়। তাদের এই ক্ষোভ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে–যখন আওয়ামী লীগের সাথে চীনের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই ঘনিষ্ঠ হয়। তারা আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষেপেছে–কারণ তাদের প্রভু আমেরিকা আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষেপেছে।


ইসলামপন্থিদের জন্য আমেরিকাপন্থি বামদের (২.খ) কান্নাটা যে কুমিরের কান্না, সেটার একটা প্রমাণ দিই। আলজাজিরা যখন ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ ডকুমেন্টারি বানিয়ে শেখ হাসিনা ও সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইল, র‍্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত গুম ও ক্রসফায়ারের বিষয়টা নিয়ে আমেরিকা যখন র‍্যাবের সাত কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দিলো (বস্তুত মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব দায় আওয়ামী লীগের ওপরেই বর্তায়), তখন আমেরিকাপন্থি বামরা (উভয়পক্ষ) ব্যাপক আনন্দে হইহুল্লোড় করা শুরু করল। এমন একটা ভাব করল, যেন আমেরিকা বিশ্বের রাজা; আর বাকি সব রাষ্ট্র হলো আমেরিকার প্রজা। রাজা এবার তার এক প্রজাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে চাচ্ছে।


অথচ আমেরিকাপন্থি এই বামদের ভেতরে যদি ন্যূনতম নৈতিকতাবোধ থাকত, তারা যদি সত্যিই মানবাধিকার রক্ষার পক্ষের কেউ হতো, তাহলে তারা সর্বপ্রথম আমেরিকাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাত। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানে লাখ লাখ মুসলমান হত্যাকারী আমেরিকা নিজেই তো সবচেয়ে বড়ো মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। অগণিত মুসলমান নারী, শিশু, বৃদ্ধকে নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। এসব গণহত্যার চাক্ষুষ প্রমাণ তো আজ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত। দিনের আলোর মতো সব পরিষ্কার। তো, একই অপরাধে অপরাধী আমেরিকা কীভাবে নিজের বিচার না করে অন্যের বিচার করতে আসে? কোন সাহসে অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন করতে আসে?"


'যা ঘটেছে যা ঘটছে যা ঘটবে' বই থেকে

লিখেছেনঃ কারিম শাওন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন