দুনিয়াখোর পর্ব ৬

আপনার শত্রুকে যদি কেউ নিজের শত্রু ভেবে তার সাথে শত্রুর মতো আচরণ করত–যেমন আচরণ আপনি আপনার শত্রুর সাথে করেন; যদিও আপনার শত্রুর সাথে তার পূর্ব কোনো শত্রুতা নেই, তখন আপনি তার ওপর কতটা খুশি হতেন? ভিষণ রকমের খুশি হতেন। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা জন্মাতো তার ওপর আপনার। পৃথিবীতে তাকেই সবচেয়ে কাছের বলে মনে হতো আপনার।


আপনার নিজের শত্রুর কথা না হয় বাদ দিন। আপনার বাবার শত্রু কিংবা আপনার মায়ের শত্রু কিংবা আপনার কোনো নিকট আত্মীয়ের শত্রুকে তো আপনি নিজের শত্রুই মনে করেন এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করেন; যদিও সেই শত্রু আপনার সাথে কোনো দিন খারাপ আচরণ নাও করে থাকে।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শত্রুদের কি ঠিক সেভাবে আমরা আমাদের শত্রু মনে করছি? না; বরং হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি। নিজের গা বাঁচিয়ে চলছি। এমনকি এদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছি। এর মানে আমাদের কাছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রাধান্য কি আমাদের পরিবারের সদস্যদের থেকেও কম?


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দেওয়া রিজিক ভোগ করে তাঁর শত্রুরা তাঁর সাথে রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তাঁর অবাধ্য হচ্ছে। তাঁর আইন-বিধানগুলো কেবল লঙ্ঘনই করেনি, উপরন্তু সেগুলোকে বাতিল করে দিয়েছে। অথচ এই জমিন তাঁর। এই বাতাস তাঁর। এই বৃষ্টি তাঁর। এই সূর্যের আলো তাঁর।


আর আমরা হলাম মুসলিম। মানব জাতির মধ্য থেকে তিনি আমাদের তাঁর নিজের জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। আমরা তাঁর প্রতিনিধি। প্রতিনিধির প্রধান কাজ তার কর্তার প্রতিনিধিত্ব করা–যেই উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আমরা কি সেই দায়িত্ব পালন করছি?

আমার কথার পক্ষে দলীল লাগবে? এই নিন দলীল।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

"স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘আমি জমিনে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি’।" (সুরা আল বাকারা : আয়াত ৩০)


"হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে (আমার) প্রতিনিধি করেছি।" (সুরা সদ : আয়াত ২৬)


"তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে (নিজের) প্রতিনিধি করেছেন।" (সুরা ফাতির : আয়াত ৩৯)


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসা (আ.)-কে বলছেন,

"আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি।" (সুরা ত্ব-হা : আয়াত ১৩)


"আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য তৈরি করেছি।" (সুরা ত্ব-হা : আয়াত ৪১)


আয়াতগুলো পাঠ করে কি বুঝলেন? নবী-রাসূলগণ কি নিজেদের জীবনটা নিজেদের জন্য যাপন করে গেছেন? না; বরং তারা জীবনভর নিজের শখ-আহলাদ বিসর্জন দিয়ে, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হয়ে কাজ করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমের শিক্ষা তো এটাই। ইসলাম তো এটাই। কোনো প্রতিনিধির নিজের জীবনটা নিজের জন্য যাপন করার সুযোগ থাকে না। তাকে তার মনিব বা কর্তা বা মালিকের জন্য কাজ করে যেতে হয় ততক্ষণ পর্যন্ত–যতক্ষণ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালনের সময়কাল ফুরিয়ে না আসে।


নবী-রাসূলগণ আমৃত্যু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শত্রুদের সাথে লড়াই করে গিয়েছেন। এ জন্য তারা নির্যাতিত হয়েছেন, নির্বাসিত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন। তারা যা করে গিয়েছেন, আমাদের জন্যও তাই করণীয়। এই উদ্দেশ্যেই তাদেরকে নবী-রাসূল হিসেবে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা হচ্ছেন পথপ্রদর্শক। আমরা হচ্ছি পথিক। তারা আমাদের অনুসরণীয়। আমরা তাদের অনুসারী।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

"আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় তুমি পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালোবাসে–হোক না এই বিরোধীরা তাদের পিতা অথবা পুত্র অথবা তাদের ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠী। আল্লাহ এদের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন, আর নিজের পক্ষ থেকে রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। তাদেরকে তিনি দাখিল করবেন জান্নাতে যার তলদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী-নালা, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল; জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সাফল্যমন্ডিত।" (সুরা আল মুজাদিলাহ : আয়াত ২২)


ইসলাম প্রশ্নে নিজের রক্তসম্পর্কীয়দেরও যখন একবিন্দু ছাড় দেওয়ার নূন্যতম কোনো সুযোগ নেই, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শত্রুদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কত নিকৃষ্টভাবেই না আমরা আমাদের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছি। ইন্না লিল্লাহ! কী জবাব দেবো সেদিন!


কত কোটি মানুষ আছে এই পৃথিবীতে! কত কোটি ছিলো! আরো কত কোটি আসবে! অগনিত! এত মানুষের মাঝে আমরা মুসলিমরা কি পারতাম না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার স্বার্থ রক্ষার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে তাঁকে ভিষণ খুশি করতে? তাঁর সন্তুষ্টির পাত্র হতে? তাঁর নৈকট্য প্রাপ্ত বান্দা হতে? ইন্না লিল্লাহ! কতটা ক্ষতিগ্রস্ত আমরা!


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনার জন্য কোন পথটা ভালোবাসেন সেটা খুঁজুন। তাঁকে যদি আপনি আপনার অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেই থাকেন তবে সেটা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দিন। তিনি যেহেতু আপনাকে এত এত মানুষের মাঝ থেকে বেছে নিয়ে হিদায়াত দান করেছেন; সুতরাং এর পেছনে অবশ্যই কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।


কি সেই উদ্দেশ্য? আসুন খুঁজে দেখি।

ধরুন ২০ কোটি মানুষ বসবাস করে এমন একটা ভূখণ্ডে ৪-৫ লাখ সেনাবাহিনী থাকে। এত এত মানুষের মাঝ থেকে এই মানুষগুলোকে সূক্ষ্মভাবে যাচাই করে বাছাই করা হয় ওই ভূখণ্ডকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তারা অন্যদের তুলনায় বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন বলেই তাদেরকে বিশেষভাবে বেছে নেওয়া হয়। আচ্ছা এই ৪-৫ লাখ সৈন্যের জীবনযাপনের ধরণ, জীবনের চলার পথ, জীবনের লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্য কি অন্যান্য সাধারণ মানুষগুলোর মতো হবে? প্রশ্নই আসে না। এই ২০ কোটি মানুষের নির্দিষ্ট একটা মতাদর্শ আছে। তারা সবাই এই নির্দিষ্ট মতাদর্শকে পছন্দ করে, অনুসরণ করে ঠিকই। তবে এই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত রাখা, সুরক্ষা দেওয়া ও সাধারণ মানুষ যেন নির্বিঘ্নে এই মতাদর্শের অনুসরণ করতে পারে প্রাণের বিনিময়ে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ওই সৈন্যদের কাঁধে।


একইভাবে সাধারণ মুসলমান এবং তাওহীদ বোঝা মুসলমানের জীবনযাপন কখনোই এক রকম হতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাওহীদ বোঝা এই মুসলমানদের যাচাই করে বাছাই করেছেন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা/রাখা, সুরক্ষা দেওয়া ও সাধারণ মুসলমানরা যেন নির্বিঘ্নে ইসলাম পালন করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য। ঠিক যেমনটা যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল নবীগণকে (আ.) এবং শেষবারের মতো রাসূল (সা.) ও তার সাহাবীগণকে (রা.)। তারা ছিলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সৈনিক। তাই আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাহাবীগণ (রা.) জিহাদের ময়দানে শাহাদাতের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে দুআ করতেন। আর আমরা দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে থেকে বেশি দিন বেঁচে থাকার জন্য দুআ করি।

তাদের ও আমাদের মাঝে কত পার্থক্য!


ইবনু ওমার (রা.) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা ফাতিমাহ্‌র ঘরে গেলেন। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করলেন না। আলী (রা.) ঘরে এলে ফাতিমাহ্‌ (রা ) তাকে ঘটনা জানালেন। তিনি আবার নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বিষয়টি নিবেদন করলেন। তখন তিনি বললেন, আমি তার দরজায় নকশা করা পর্দা ঝুলতে দেখেছি। দুনিয়ার চাকচিক্যের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আলী (রা ) ফাতিমাহ্‌র নিকট এসে ঘটনা খুলে বললেন। ফাতিমাহ (রা.) বললেন, তিনি আমাকে এ সম্পর্কে যা ইচ্ছা নির্দেশ দিন। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, অমুক পরিবারের অমুকের নিকট এটা পাঠিয়ে দাও; তাদের প্রয়োজন আছে।  

(সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২৬১৩)


আল্লাহু আকবার!

বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে তাদের দ্বীন-দুনিয়া এবং আমাদের দ্বীন-দুনিয়া দেখলে। আমরা কি কিয়ামতের দিন আদৌ তাদের সঙ্গী হতে পারব? মুসলিমদের জন্য দরজায় পর্দা ব্যবহার করা কিন্তু অবৈধ কোনো কাজ না; বরং বাধ্যতামূলক। তবে সেটা হতে হবে সাদামাটা। রাসূল (সা.)-এর কথাটার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করুন একটু। কথাটা শুনলে কি মনে হচ্ছে না যে–আল্লাহর রাসূল (সা.), সাহাবাগণ (রা.) তারা ভিন্ন কোনো জগতের মানুষ? যেমন, আকাশ থেকে ফেরেশতারা নেমে আসার পর যদি তাদের সিন্দুক ভরা সোনা-রূপা, হীরে-জহরত, মনি-মুক্তো দেওয়া হয়, তখন ফেরেশতারা স্বাভাবিকভাবেই বলবে– এগুলো দিয়ে আমরা কি করব?


অর্থ-সম্পদ থেকে তারা কীভাবে দূরত্ব বজায় রাখতেন! এটা ঠিক দূরত্ব না; এটাকে বলা উচিত বিভেদ। অর্থাৎ আলো যেমন আঁধারের বিপরীত, সাদা যেমন কালোর বিপরীত, ডাঙা যেমন জলের বিপরীত, ঠিক তেমনি তাদের এবং দুনিয়াবি এ সব চাকচিক্যের মাঝে ছিল অনতিক্রম্য এক বিভেদ রেখা। এক দূর্ভেদ্য প্রাচীর। না তারা দুনিয়ার প্রতি প্রলুব্ধ হতেন, না দুনিয়া তাদের প্রলুব্ধ করতে পারত। তারা মুসাফিরের মতো জীবন কাটাতেন। তাদের পথ চলাই বলে দিত তারা এক স্থান থেকে যাত্রা করেছেন নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যের দিকে। পথের জন্য যেটুকু পাথেয় দরকার, তারা সেটুকুই নিয়েছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত তো রাখেননি; বরং কম রেখেছেন। এমনকি অনেক সময় চাহিদার মুখে লাগাম টেনে দিয়েছেন।


লিখেছেনঃ কারিম শাওন 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন