দুনিয়াখোর পর্ব ৭

 

আপনি যদি ২৫-৩০ বার সম্পূর্ণ কুরআনুল কারিমের তরজমা পড়েন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একটা মূল বার্তা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন–নবীদের মাধ্যমে আমার এই আইন-কানুনগুলো পাঠিয়েছি। এগুলো নিজের জীবন ও সমাজে বাস্তবায়ন করো। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে পার্থিব ভোগ-বিলাসিতা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে। কারণ, চারপাশ খারাপ লোকে ভরা। দুনিয়াবিমুখ হও। দুনিয়া ছলনার বস্তু ও ক্ষনস্থায়ী। আখিরাতমুখী হও। আখিরাত সর্বোৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী।


কিছু আয়াত দেখুন যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুমিনদেরকে জিহাদ করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি আমাদের কাছ থেকে আসলে কি চান, আমাদের কোন কাজটাকে তিনি সবচেয়ে পছন্দ করেন, সেটা এই আয়াতগুলোতে উঠে এসেছে।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

"তোমরা কি ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ এখন পর্যন্তও পরখ করেননি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর কারা ধৈর্যশীল।"

(সুরা আল ইমরান : আয়াত ১৪২)


"সুতরাং যারা আখেরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করুক এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, অতঃপর সে নিহত হোক অথবা বিজয়ী হোক, অচিরেই আমি তাকে মহা প্রতিফল দান করব।"

(সুরা আন নিসা : আয়াত ৭৪)


"তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নারী-পুরুষ আর শিশুদের (রক্ষার) জন্য লড়াই করবে না, যারা দুআ করছে- 'হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এ যালিম অধ্যূষিত জনপথ হতে মুক্তি দাও, তোমার পক্ষ হতে কাউকেও আমাদের বন্ধু বানিয়ে দাও এবং তোমার পক্ষ হতে কাউকেও আমাদের সাহায্যকারী করে দাও।'"

(সুরা আন নিসা : আয়াত ৭৫)


"তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে যে পর্যন্ত আল্লাহ জেনে না নেবেন তোমাদের মধ্যে কারা তাঁর পথে জিহাদ করেছে, আর আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেনি? তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।"

(সুরা আত তাওবাহ : আয়াত ১৬)


"যারা ঈমান আনে, হিজরাত করে, আর নিজেদের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে, আল্লাহর নিকট তাদের বিরাট মর্যাদা রয়েছে, এরাই হলো সফলকাম।"

(সুরা আত তাওবাহ : আয়াত ২০)


"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের হয়েছে কী যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন তোমরা আরো জোরে মাটি কামড়ে ধর। তোমরা কি আখেরাতের স্থলে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি পছন্দ কর? আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী তো অতি সামান্য।"

(সুরা আত তাওবাহ : আয়াত ৩৮)


"নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান আর মাল কিনে নিয়েছেন কারণ তাদের জন্য (বিনিময়ে) আছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। অতঃপর (দুশমনদের) হত্যা করে এবং (নিজেরা) নিহত হয়। এ ওয়াদা তাঁর ওপর অবশ্যই পালনীয় যা আছে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে। আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশী নিজ ওয়াদা পালনকারী? কাজেই তোমরা যে ক্রয় বিক্রয় সম্পন্ন করেছ তার জন্য আনন্দিত হও, আর এটাই হলো মহান সফলতা।"

(সুরা আত তাওবাহ : আয়াত ১১১)


"হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দেব যা তোমাদেরকে মর্মান্তিক আযাব থেকে রক্ষা করবে? (তা এই যে) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো আর তোমরা তোমাদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ কর; এটাই তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে!" (সুরা আস সফ : আয়াত ১০-১১)


এই আয়াতগুলোতে সুস্পষ্টভাবে জিহাদের ময়দানে যাওয়ার বিপরীতে পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাসিতাকে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ দুনিয়াপ্রীতিই একজন মুমিনের জিহাদী জীবনের প্রধান অন্তরায়।


যাঁকে দেখা যায় না, যাঁর কথা আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি, যাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ পার্থিব জগতে কেউ দিতে পারেনি, এমনকি বহু মানুষ যাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদী হয়ে বসে আছে; এমন সত্ত্বার জন্য নিজের প্রিয় দুটো বস্তু–জান ও মাল বিসর্জন দেওয়াটা মামুলি কোনো কথা না। নিশ্চিত বিশ্বাসী হতে হবে। একমাত্র নিশ্চিত বিশ্বাসীরা ছাড়া এই কাজটা কেউই করতে পারবে না। যাদের অন্তরে সন্দেহের রোগ আছে কেবল তারাই এটা থেকে পালিয়ে বাঁচতে নানান অজুহাতের অবতারণা করবে। মুখে মুখে "ঈমান এনেছি" বলা মানুষগুলো আদৌ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে বিশ্বাস করে কি না, আখিরাতে বিশ্বাস করে কি না, সেটার উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে এই পন্থায়। কারণ, নিশ্চিত বিশ্বাসী একজন মুমিন মহান প্রতিপালকের সাক্ষাৎ পেতে, তাঁর নিকটবর্তী হতে ব্যাকুল ও উতলা হয়ে থাকে। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকটবর্তী হওয়ার একমাত্র উপায় হলো তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে পৃথিবী থেকে প্রস্থান করা। পৃথিবী তাঁর থেকে অনেক দূরে। আর জান্নাত তাঁর আরশের একেবারে নিকটে।


এ জন্যই পবিত্র কুরআনুল কারিমের একেবারে শুরুতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন,


"তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরকালের প্রতিও তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী। তারাই তাদের প্রতিপালকের হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, আর তারাই সফলকাম।"

(সুরা আল বাকারা : আয়াত ৪-৫)


মনে প্রশ্ন আসতে পারে–এত কিছু থাকতে প্রাণটাই কেন দিতে হবে? কারণটা খুব সহজ ও যৌক্তিক। একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো–তার নিজের প্রাণ এবং সম্পদ। আর কাউকে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভালোবাসার প্রমাণ হলো–তার জন্য এই দুটো জিনিসকে বিসর্জন দেওয়া। এ জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,


"তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু খরচ না করা পর্যন্ত কক্ষনো পুণ্য লাভ করবে না, যা কিছু তোমরা খরচ কর–নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব ভালভাবেই অবগত।"

(সুরা আল ইমরান : আয়াত ৯২)


এবং সেটা হতে হবে বিশুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ জান-মাল। ভেজাল জিনিস তিনি ক্রয় করেন না। এটা তাঁর শান, মান, মর্যাদার সাথে যায় না। এমনকি আমরাও ভেজাল জিনিস ক্রয় করি না। তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার জন্য একটা চতুষ্পদ জন্তুও তো নিখুঁত হতে হয়। কুরবানীর মতো একটা ইবাদাতের আড়ালে লুকিয়ে আছে মহৎ একটা শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা। শাহাদত লাভ করতে চাইলে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য মুমিনের উপার্জন হালাল হতে হবে, মানসিকতা সৎ ও উদার হতে হবে, নিঃস্বার্থ পরোপকারী হতে হবে, দৃষ্টি ও যৌনাঙ্গের হেফাজত করতে হবে, চরিত্র সুন্দর ও মার্জিত হতে হবে, হিংসা-অহংকার-বিদ্বেষ পরিত্যাগ করতে হবে, লোক দেখানো ইবাদাত বাদ দিতে হবে–এখন সেটা দাওয়াত হোক কিংবা ব্যক্তিগত আমল। বাদবাকি বৈশিষ্ট্য সুরা আত তাওবাহর ১১২ নং আয়াতে আছে। 


লিখেছেনঃ কারিম শাওন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন