দুনিয়াখোর পর্ব ৮

 

আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কথাই স্মরণ করা যাক। একজন উৎকৃষ্ট বস্তু কুরবানী করেছিলেন। আরেকজন নিকৃষ্ট বস্তু কুরবানী করেছিলেন। প্রথম জনেরটা গ্রহণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় জনেরটা গ্রহণ করা হয়নি।


তাই যারা শাহাদাতের মতো সর্বোচ্চ সম্মান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়, তাদের জেনে রাখা উচিত–শাহাদাতের মৃত্যু এমন কোনো বিষয় নয় যা কেউ চাইলেই পেয়ে যাবে; বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী বাছাই করে নেবেন। তিনি মহান সত্ত্বা। তিনি পবিত্র। তাঁর মর্যাদা সর্বোচ্চ। তাঁর জন্য তিনি আপনার ত্রুটিপূর্ণ জান ও মাল কবুল করবেন কি না সেটাই বরং ভেবে দেখার বিষয়।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

"এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি যাতে আল্লাহ মু’মিনদেরকে চিনে নিতে পারেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।"(সুরা আল ইমরান : আয়াত ১৪০)


কথাগুলোকে নিজের সাথে মিলিয়ে নিন। যদি ইতিবাচক ফলাফল আসে তবে আপনি সঠিক পথে আছেন। আর যদি নেতিবাচক ফলাফল পান তবে জরুরি ভিত্তিতে নিজের ঈমান ও আমলের সংস্কার করুন। কারণ, আপনার হাতে সময় অতি অল্প। আপনার মৃত্যু কখন চলে আসে সেটা আপনি জানেন না। আর যদি এভাবেই আপনার মৃত্যু হয়, তবে সেটা হবে মুনাফিকের মৃত্যু। আউজুবিল্লাহ!


হিদায়াত পাওয়ার পর পুনরায় পথহারা এই মানুষগুলো নিজেরা দুনিয়াবিমুখ তো হয়ইনি; উলটো যারা দুনিয়াবিমুখ হয়ে জুহুদ অবলম্বন করে চলার চেষ্টা করছে, তাদেরকেও তারা তিরস্কার করে। আড্ডার আসরে জুহুদ অবলম্বনকারীদের জীবিকা নির্বাহের বিষয় নিয়ে তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।


জুহুদ অবলম্বনকারীরা রাসূল (সা.) এবং সাহাবিগণের (রা.) উদাহরণ দেখিয়ে দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসিতাকে উপেক্ষা করে চলতে চাইলে সেটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে।


জুহুদ অবলম্বনকারীরা যদি শিরক-কুফুরির ভূখণ্ড ছেড়ে এমন কোনো ভূখণ্ডে হিজরত করে চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে বলে মনের অভিপ্রায় প্রকাশ করে–যেখানে তুলনামূলক বেশি ইসলামি আইন মেনে চলা যাবে, তখন সেটা নিয়ে তারা উপহাস করে।


জুহুদ অবলম্বনকারীরা যখন বলেন, আমরা শাহাদাতের তামান্না বুকের মধ্যে লালন করে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি–কবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে জিহাদের ময়দান থেকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নেবেন। ভেতরে অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতা ও ভয় কাজ করে। কারণ, যদি হুট করে মৃত্যু চলে আসে। তাহলে তো আর শহীদের মর্যাদা কপালে জুটবে না। পার্থিব জীবন তো একটাই। তাই অর্থ-সম্পদের পেছনে ছুটছি না। আত্মসম্মান নিয়ে সচ্ছলতার সাথে বেঁচে থাকতে যতটুকু লাগে, আমরা ততটুকুই উপার্জন করব। আমরা অল্পতেই সন্তুষ্ট আছি। আলহামদুলিল্লাহ! তখন তারা জুহুদ অবলম্বনকারীদের এই প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে।


ইসলাম চর্চা করে এমন সবাইকে জিজ্ঞেস করলে তারা জোর দিয়েই বলবে আমরা রিজিকের ব্যাপারে আল্লাহর ওপর ভরসা করি। এই যে দাবিটা তারা করে–কি মনে হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই কথার প্রমাণ নেবেন না? অবশ্যই নেবেন।


"লোকেরা কি মনে করে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম; অতঃপর আল্লাহ অবশ্যই অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যেবাদী।"(সুরা আল 'আনকাবুত : আয়াত ২-৩)


কারো ঈমানের অবস্থা কেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ওপর কারো তাওয়াক্কুল কতটুকু, সেটার উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে রিজিকের ব্যাপারে তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো দেখলে। মুখে মুখে আমরা সবাই পাক্কা দ্বীনদার, বুজুর্গ, পরহেজগার, মুত্তাকী, তাওহীদবাদী। কোনো মজলিসে ইসলাম নিয়ে কথা বলার সময় মনে হয় আমাদের চেয়ে বড়ো দ্বীনদার, বুজুর্গ, পরহেজগার, মুত্তাকী, তাওহীদবাদী আর কেউ নেই। কিন্তু তলায় হাত দিলেই টের পাওয়া যায় কে কত বড়ো দ্বীনদার, কার বুজুর্গির গভীরতা কত, কে কতটুকু পরহেজগার, কে কতটা মুত্তাকী, আর কে প্রকৃত তাওহীদবাদী।


আমাদের প্রত্যেকের অন্তরের খবর সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন আমাদের মহান রব। দ্বীনের ব্যাপারে যা বলছি আদৌ তা মন থেকে বলছি কি না, যা বলছি তা আমি নিজে মেনে চলি কি না, আমার ওপরের ধার্মিকতা আর অন্তরের ধার্মিকতা এক কি না, তা তিনি এই দুনিয়াতেই পরীক্ষা করে নেবেন। অবশ্যই অবশ্যই নেবেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ফেলবেন– যে আমাদের আসল চেহারাটা প্রকাশ পেয়ে যাবে; এখন সেটা মুমিনের চেহারা হোক কিংবা মুনাফিকের।


দুনিয়াখোররা সব সময় রিজিক নিয়ে ভয়ের মধ্যে থাকে। তারা পর্যাপ্ত রিজিকের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায়। তাই ভবিষ্যতের জন্য অঢেল সম্পদ জমা করতে উদগ্রীব থাকে। নূন্যতম ঝুঁকির মধ্যে থাকতে তারা নারাজ। গোল একটা বলের গায়ে সজোরে লাথি দিলে যেমন বোঝা যায়–বলের ভেতরে বাতাস কতটুকু। এই দুনিয়াখোরদের অন্তরের ভেতরে ঈমানের বাতাস কতটুকু আছে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের ওপর অর্থনৈতিক ও শারীরিক কোনো বিপদ-আপদ আসলে। তাদের ঈমান, ইয়াকিন ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ওপর তাওয়াক্কুলের অবস্থা কিরূপ, সেটার প্রমাণ পেতে জিহাদের ময়দান ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করার দরকার নেই। কারণ, এটা সর্বোচ্চ কঠিন পরীক্ষা। বেশি কিছু করতে হবে না, সাধারণ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করলেই এদের বাতাস বের হয়ে যাবে।


যেমন, মোটামুটি কঠোরভাবে দ্বীন পালনের চেষ্টা করে এমন কোনো ছেলের কাছে দুনিয়াখোররা মেয়ে বিয়ে দেবে না। কারণ, আগেই বলেছি কুফুরি রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একজন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি ঠিক ততটুকুই উপার্জন করবে, যতটুকু উপার্জন করে সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচা যায়। কিন্তু এতে ওই দুনিয়াখোররা সন্তুষ্ট নয়। এমনকি অন্যদেরকেও অনুৎসাহিত করে যেন এমন ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে না দেয়। তারা যদি প্রকৃত দ্বীনদার হতো তাহলে প্রথমে ছেলের ঈমানের খবর নিত। ছেলের দ্বীনদারিতার খবর নিত। ছেলের চরিত্র কেমন, চোখের হেফাজত করে কি না, উপার্জন হালাল কি না, দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নিজেকে উৎসর্গ করার মন-মানসিকতা লালন করে কি না ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ নিত। এসব বিষয়কেই ছেলের যোগ্যতা বিচার করার মূল মানদণ্ড ধরত।

লিখেছেনঃ কারিম শাওন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন