সেন্টমার্টিন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভারত ও আমেরিকার অনুগত মিডিয়াগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে খবর প্রচার করছে।
কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে এটা বাংলাদেশের জন্য হুমকি না। এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা।
যারা সেন্টমার্টিন গিয়েছেন তারা দেখে থাকবেন টেকানাফের নাফ নদীর এপারে বাংলাদেশ। ওপারে মিয়ানমার। এই নাফ নদীর অধিকার দুই দেশের জন্য অর্ধেক-অর্ধেক। অর্থাৎ নাফ নদীর মধ্যভাগ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা।
নাফ নদীর ওপারের অংশের পুরোটাই মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য। মাইলের পর মাইল বিশাল সমুদ্র সৈকত।জনমানবহীন। এগুলোর অধিকাংশই অরক্ষিত। এই আরাকান রাজ্যেই মিয়ানমারের জান্তা সামরিক বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির তুমুল লড়াই চলছে। জান্তা বাহিনী সবচেয়ে বেশি প্যাঁদানি খাচ্ছে আরাকান আর্মির হাতেই। মিয়ানমারের কোনো ভূখণ্ড যদি সর্বপ্রথম স্বাধীন হয়–তবে সেটা হবে আরাকান রাজ্য। আরাকান আর্মির সংখ্যা অন্যান্য বিদ্রোহীদের থেকে বেশি এবং শক্তিশালী। মোটামুটি এস্টাবলিশ্ড আর্মি বলা যায়।
কিন্তু আরাকান আর্মির হাতে যুদ্ধের কোনো ভারী সরঞ্জাম নেই। যেমন: ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ। এগুলো আছে জান্তা সামরিক বাহিনীর হাতে। জান্তা বাহিনী এখন সমুদ্রপথে আরাকান আর্মিকে চেপে ধরার চেষ্টা করছে। স্থলভাগের যেই এলাকাগুলো আরাকান আর্মি বিগত কয়েক মাসে নতুন করে দখল করেছে, সেগুলো এই জলপথ দিয়ে উলটো দিক থেকে আক্রমণ করে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে হয়তো। তাই নাফ নদীতে চলমান গোলাগুলির লড়াইটা মূলত জান্তা বনাম আরাকানের মধ্যে হচ্ছে।
যেহেতু বর্ডার এলাকা তাই কিছু গোলাবারুদ বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসছে। মিয়ানমারের জান্তা সামরিক বাহিনীর সেই কলিজা নেই যে, সরাসরি বাংলাদেশে আক্রমণ করবে। ২০০০ সালের নাফ যুদ্ধের শিক্ষা এখনো মনে আছে ওদের। (এটা নিয়ে আলাদা একটা আর্টিকেল লিখব ইনশাআল্লাহ।) সুতরাং, মিডিয়া যেভাবে দেখাচ্ছে তেমন কিছু হলে বিজিবি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড পালটা পদক্ষেপ নিতো।
তাছাড়া কিছু দিন আগে দেখেছেন মিয়ানমারের সেনারা আরাকান আর্মির আক্রমণের তোপে টিকতে না পেরে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশ তখন বেশ সৌজন্যমূলক আচরণ করেছিল। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী এত দ্রুত সেসব ভুলে গিয়ে বেঈমানী করবে বলে মনে হয় না।
তো খবরে যে দেখাচ্ছে, বাংলাদেশের যাত্রীবাহী ট্রলারগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছে। এটা কি মিথ্যা ঘটনা?
এটা মিথ্যা না। মূল নাফ নদী এবং এর শাখা-প্রশাখায় ছোটো ছোটো ট্রলার নিয়ে চলাচল আরাকান আর্মিরাও করে। ওদের যাতায়াত বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে হয়। সত্যি বলতে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আরাকান আর্মিকে আশ্রয়, অস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়। এটা করা হয় বাংলাদেশের স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই। কারণ, মিয়ানমারও বাংলাদেশের উপজাতি সন্ত্রাসীগোলোকে আশ্রয় ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে।
যাহোক, এটা নিয়ে জান্তা সামরিক বাহিনী বেশ ফাঁপরে থাকে। তাই ওরা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে চলাচলকারী ট্রলারগুলোর দিকে গুলি ছুড়েছে। জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। করাটাই স্বাভাবিক। নিরাপত্তার জন্যই টেকনাফ টু সেন্টমার্টিন ট্রলার চলাচল বন্ধ আছে। বিকল্প পথে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার একাধিক পথ আছে। শাহপরীর দ্বীপ থেকে কিংবা কক্সবাজার থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন যাওয়া যায়। সমস্যা সেন্টমার্টিনে না। সমস্যা টেকনাফ সীমান্তের এই দিকটায়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্ব দিকে (মিয়ানমার ও সেন্টমার্টিনের মাঝখানে) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা যুদ্ধ জাহাজ সবসমসয় স্ট্যান্ড বাই থাকে। বিজিবি, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড সদস্যরা ট্রলার নিয়ে নিয়মিত টহল দেয়। সুতরাং বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই আপাতত।
তবে একটা আশংকা থেকে যায়। এই মাঙ্কিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না। মিয়ানমার যদি বিভক্ত হয়, তখন বর্তমান জান্তা বাহিনী কিন্তু সম্পূর্ণ মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ হারাবে না। বেশ কিছু রাজ্য হারাবে। কারণ, জান্তা সামরিক বাহিনী একটা প্রতিষ্ঠিত সামরিকবাহিনী। ওদের কাছে এমন এমন যুদ্ধের সরঞ্জাম আছে, যেগুলো কি না বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীগুলোর কাছেও নেই। কিছু সরঞ্জাম থাকলেও কম সংখ্যক বা মান্ধাতার আমলের। যেমন : এ্যটাক হেলিকপ্টার, আধুনিক যুদ্ধ বিমান, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, লঙ রেঞ্জ মিসাইল, আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ ইত্যাদি।
যাহোক। যদি শেষমেশ মিয়ানমার বিভক্ত হয়েই যায়, আর যেহেতু বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোকে চীন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে; সেহেতু আমেরিকা মিয়ানমারের ওপর নেওয়া আগের সব স্টেপ উইথড্র করে, সব ঝগড়াঝাটি মিমাংসা করে বর্তমান জান্তা সামরিক সরকারকে নিজেদের ব্লকে টেনে নিতে চাইলে এই অঞ্চলের খেলা নতুন মোড় নেবে।
জান্তা সরকার আমেরিকার এই প্রস্তাব মেনেও নেবে। তাছাড়া ভারতের সাথে মিয়ানমার জান্তা সরকারের সম্পর্ক ভালো ছিল বলেই তো 'কালাদান প্রজেক্ট' করতে দিয়েছিল মিয়ানমার। এটা নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ুন।)
ছবিতে লাল অংশটা আরাকান রাজ্য। আরাকানের আরেক নাম রাখাইন স্টেট। কমলা রং ও লাল রংয়ের মাঝের সরু জায়গাটই নাফ নদী।
লিখেছেনঃ কারিম শাওন


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন