সিরিয়া বিপ্লবের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ | পর্বঃ ১-২

 

পর্বঃ ১

ঠিক যেভাবে শিয়া-রাশিয়া প্রোপাগান্ডা মেশিন সিরিয়ার মুজাহিদদে আইসিস (IsIs) বলে বেড়াচ্ছে, ঠিক সেভাবেই এদেশে গণতান্ত্রিক গং আমাদের অনেককে আইসিস বলে বেড়ায়। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই আইসিসের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম দাড়িয়েছিল এই মুজাহিদ দলগুলোই। এমন কি এদেশেও আইসিসের বিরুদ্ধে সবার আগে যারা কলম ধরেছিল, তাদেরকেই উল্টা আইসিস ট্যাগ দেয়া হয়। কিন্তু কেন?
কেনো তারা শুধু একিউ (আল-কায়দা) এমনকি এখন আর তালিবান ট্যাগও দেয় না - বরং আইসিস ট্যাগ জুড়ে দেয়?

 

কারণ সহজেই যেন ক্যান্সেল আউট করা যায়, তাদের হয়রানি করা যায় টেকনিক্যালি তাদের জানমাল হালাল করে দেয়া যায় সরকারী বাহিনীগুলো উসকানি দিয়ে। এবং নিজেদের শঠতা, আইডিওলজিকাল দুর্নীতিগুলো জাস্টিফাই করা যায়।
শিয়া-রাশিয়া কি জানে না, সেখানে আইসিস নেই? অবশ্যই জানে। আইসিস প্রায় বিলুপ্ত এবং তাদের কোমর ভেঙে গেছে। আইসিস পিছন থেকে ছুরি না মারলে হয় আরো ১০ বছর আগেই আমার দামস্কাসের (সিরিয়া/নামের রাজধানী) বাশারের প্রাসাদ ভেঙে ফেলতে পারতাম। কিন্তু ১০ বছর আগের কথা, তখন আইসিস নিজেদের ক্ষমতার জন্য, বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঝে অন্যান্য সুন্নী দলের সাথে যুদ্ধ শুরু করে।

আইসিসের দাবী বাকিরা শরীয়াহ কায়েমের জন্য যুদ্ধ করে না, মুক্ত এলাকায় শরীয়াহ কায়েম করে না, এবং তারা পশ্চিমা সমর্থন প্রাপ্ত। লাস্ট পয়েন্টে শিয়াদের সাথে আইসিস একমত। অথচ কথাগুলো আংশিক সত্য। কিছু দল সত্যই শরীয়াহ কায়েমের জন্য যুদ্ধ করতো না। ঠিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করুন, বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সকলেই শরীয়াহপন্থী না। আবার মুক্ত এলাকায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সচ্ছ বিচার নিশ্চিত না করে হুদুদ কায়েম করা সম্ভব নয় যোদ্ধাদের জন্য। অথচ আইসিস এটাকে নাম দিয়েছে তারা শরীয়াহ কায়েম করছে না। উল্টো তারা যেনতেন ভাবে মুক্ত অঞ্চলে নিজেদের মনমত কোর্ট স্থাপন করে বিচার করে হুদুদ কায়েম করার চেষ্টা করেছে, যেটার সচ্ছতা নিয়ে বাকিদের সাথে, জনগণের তাদের ঝামেলা তৈরী হয়েছে।

[ হুদুদ - ইসলামী এমন শাস্তিকে বোঝায় যেগুলো ইসলামী আইনের অধীনে (শরীয়াহ) আল্লাহ কর্তৃক বাধ্যতামূলক এবং নির্ধারিত। https://tinyurl.com/45nmjb7v ]


গুলো ছাপিয়ে মূল কথা ছিল, আইসিস জোর করে সবার নেতৃত্ব নিতে চাইছিলো, অথচ সকলে তাদের নেতৃত্ব মানতে রাজি ছিল না। এমনকি এক পর্যায়ে আইসিস নিজেদের আমীরকে খলিফা বলে ঘোষণা করে যেন সব সুন্নী দলের উপর বাধ্যবাধকতা আসে খলিফার আনুগত্যের জন্য।
তারা বাকি সুন্নী দলগুলোর সাথে পলিটিক্যাল এবং ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন না রেখে জোর করে যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের নিজেদের অনুগত হবার জন্য বাধ্য করার পথ বেছে নিলো। লাভ কি হল? উভয়পক্ষ যুদ্ধ করে নিজেদের দূর্বল করলো। এবং এই ফাঁকে শিয়ারা এবং বাশার আল-আসাদ একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

একিউ শুরুতে এই যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করলেও, আইসিস তাদের যুদ্ধের জাস্টিফিকেশন হিসেবে বাকিদের বিভিন্ন ভুল-ত্রুটি বের করে তাকফির করা শুরু করলো। এমনি কোন একদলের মধ্যে কুফর পাওয়া গেলে সেটা বাকি সবার জন্য জেনারালাইসড করা শুরু করলো। তখন থেকে মুজাহিদ এবং উলামারা তাদের খাওয়ারিজ বলা শুরু করলো। একটা পর্যায়ে তারা যখন সুন্নী গ্রুপগুলো ধরাশায়ী করে প্রবল প্রতাপের সাথে তেল ক্ষেত্রগুলো জয় করছিল, ঠিক তখন আমরিকা তার মিত্রদের নিয়ে তাদের উপর এটাক শুরু করলো। সাথে রাশিয়াও।

এত দিন আমরিকা চুপচাপ সুন্নী গ্রুপগুলোর সাথে আইসিসের যুদ্ধ দেখছিল। সময়টা ২০১৩ থকে ২০১৫। যখন তারা কুর্দী এলাকাগুলোতে ঢুকলো, যেগুলো তেল ক্ষেত্রে ভরপুর, তখন পর্যন্ত তুর্কিও আইসিসের পক্ষে ছিল। এমনকি শোনা যায় যে আইসিস ব্ল্যাকমার্কেটে তুর্কির কাছেই তেল বেঁচতো। কিন্তু আমরিকা এবং তাদের মিত্রদের আক্রমণের চোটে, আইসিস বাধ্য হয় তার দখলকৃত এলাকাগুলো ছেড়ে দিতে যা তারা সুন্নী দলগুলোর থেকে দখল করেছে, যেগুলো আবার শিয়া আসাদ বাহিনী থেকে মুক্ত করেছিল সুন্নী দলগুলো। এখন সেগুলো আমরিকা-রাশিয়া সমর্থিত মার্কসবাদী কুর্দী বাহিনীর দখলে। এবং তেলক্ষেত্রেগুলো টেকনিক্যালি আমারিকা-রাশিয়া মিলে মিশে খায়।

পর্বঃ ২

এক ভাই মজা করে বলেছিলেন যে, বেরলভীরা হচ্ছে শিয়াদের সুন্নী শাখা। আজ একখানে দেখলাম যে, বেরলভীদের একটা গ্রুপ সিরিয়ার মুজাহিদদের তাকফিরী খারিজী বলে প্রচার করতেছে। তাদের প্রমাণ হলো শিয়াদের বানানো এডিটেড ভিডিও আর প্রোপাগান্ডা নিউস। মুজাহিদরা নাকি ইজরায়েলের দালাল, সিআইএ ট্রেইন্ড। আর ইরান-রাশিয়া হচ্ছে খাঁটি মুসলিম, কোন ধরণের জুলুম তারা করতেই পারে না।

হবেই না কেন? তথাকথিত সুফী রমজান কাদীরভ তো পুতিনের খাস চামচা, যে এখন চেচনিয়ার শাসক। অর্থাৎ আক্বীদা-মানহাজগত কারণেই রাজনৈতিকভাবে তারা শিয়া ব্লকে থাকবে। অনেকে বলে তারা সিরিয়ার বিষয়ে কনফিউসড, কে হক্ব তারা বুঝতে পারতেসে না। আমি উত্তরটা জানি!
উত্তর হলো, আপনার কুরআন পড়া নেই, সীরাহ পড়া নেই, সাহাবাদের বিশেষ করে খলিফাদের জীবনীগুলো জানা নেই। শুনুন কুরআন আপানাকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে শিখাবে। সাথে সাথে গুনাহ মুক্ত জীবন। যেটা আসলে আমার নিজের ক্ষেত্রেও খুব কমতি আছে। যা ভুল হয়, হচ্ছে - সেটা একারণেই মূলত।

তারপর আসবে শামের বিষয়ের হাদিস এবং মর্যাদা জানা নিয়ে। এরপর আসবে বিভিন্ন দলের আক্বীদা, আইডিওলজি, মানহাজ এগুলো জানা নেই। এজন্য আপনারা আসলে কোন খবর আসলে কতটুকু সত্য - কতটুকু মিথ্যা, কে কেনটা কোন উদ্দেশ্যে করতে পারে সেটা বুঝতে পারছেন না।
আপনাকে জিও-পলিটিক্স এবং ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সও বুঝতে হবে। নতুবা শিয়াদের খপ্পড়ে পড়বেন। শুরুটা হবে তাদের রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতে পড়ে। এরপর তাদের অপরাধ জাস্টিফিকেশন, এরপর সাহাবাদের বিষয়ে বিষোদগার। এরপর এই সাহাবাদের দিয়ে আল্লাহ তা'আলা কুরআন সংরক্ষণ করেছেন, সেই কুরআন নিয়েই সন্দেহ শুরু হবে। আর আমাদের তারা তাদের মত কাফির বানিয়েই ছাড়বে।

এরদোগান, তুর্কি যদি ইরানের বিরুদ্ধে না যেত, আমার ধারণা, জামাতের বেশীর ভাগ লোক শিয়াদের সমর্থন করতো। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড ৫০ বছর আগ থেকেই এই আসাদ পরিবারের সাথে লড়াই করছে, এ কারণে জামাতের লোকজন পুরোপুরি ইরানের সমর্থন করতে পারছে না। তবুও অনেক বিভ্রান্তকে দেখা যায় আজকে ইরান তো কালকে তুর্কি আবার দুইটা মিলিয়ে কিসব গোঁজামিল যে দেয়!

জোট সরকারের আমলে এদেশে ইরানের ব্যাপক প্রমোশন হয়েছিল। সাধারণ মানুষের সাথে সাথে জামাত সমর্থকরও ইরান প্রীতিতে মজে ছিল। কিন্তু সিরিয়ার ঘটনা আবার ২০১১ এরপর শুরু হলে অনেকের মোহ ভাঙ্গে। আবার ২০১৯ পর সেই মোহ ফিরে আসে। অনেকে আবার শিয়া প্রীতিতে ফিরে যায়। অথচ এই দেশে শিয়াদের বিষয়ে আমাদের প্রজন্মের স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মূল কারণই ছিল সিরিয়ান ইস্যু। ফালিস্তিন দিয়ে শিয়ারা নিজেদের তাকিয়া প্রোজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু করলে আল্লাহ তা'আলা সিরিয়া দিয়ে সেটা নস্যাৎ করছেন। তবে যারা হতভাগা, তারা আসলে সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখেও সত্যকে গ্রহণ করবে না।

লিখেছেনঃ Bearded Bengali

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন