ওয়াকিটকি (Walkie-Talkie) সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহার না থাকায় তেমন কিছু জানা সম্ভব না হওয়ারই কথা তবে ওয়াকিটকি (Walkie-Talkie) প্রযুক্তির কার্যপদ্ধতি, ব্যবহার এবং সুবিধাগুলি সম্পর্কে টুকটাক তুলে ধরা হলোঃ
ওয়াকিটকি কী?
ওয়াকিটকি একটি দ্বৈত (Two Way) রেডিও ডিভাইস যা দুই বা তার বেশি ব্যক্তির মধ্যে সরাসরি, দ্রুত এবং দ্বিমুখী যোগাযোগ করতে ব্যবহৃত হয়। ট্রান্সিভারের মতো ওয়াকিটকি কথা গ্ৰহণ এবং প্রেরণ করতে পারে।
এটি সাধারণত ছোট আকারের, পোর্টেবল (সহজে বহনযোগ্য) এবং ব্যাটারি চালিত ডিভাইস, যা HF = ( High Frequency ), VHF (Very High Frequency) এবং UHF (Ultra High Frequency) ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করে। এই ব্যান্ড হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি ফ্রিকোয়েন্সি পরিসীমাকে বোঝায় যা কোনো নির্দিষ্ট ধরনের সিগন্যাল, তড়িৎ তরঙ্গ বা যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়। একে Hz হার্জ (Hertz) একক দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
ওয়াকিটকি মূলত একটি রেডিও স্টেশন হিসেবে কাজ করে এবং টক বাটন (Push-to-Talk) প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সহজেই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এটির Push-to-Talk (PTT) বাটনে চাপ দিয়ে কথাবার্তা বলতে হয়, এবং PTT বাটনে চাপ ছেড়ে দিলে অপরপাশের ব্যাক্তি কথা বলতে পারে। একই সাথে, একই সময়ে দুই ব্যক্তি কথা বলতে পারে না, যেমনটা মোবাইলে পারা যায়। তবে বর্তমানে আধুনিক ওয়াকিটকি গুলো ভিন্ন হতে পারে।
ওয়াকিটকির এবং ফ্রিকোয়েন্সিঃ
ওয়াকিটকি বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড ব্যবহার করে। যেমনঃ
১। HF (3 MHz থেকে 30 MHz / মেগাহার্জ)
২। VHF (30 MHz থেকে 300 MHz) এবং
৩। UHF (300 MHz থেকে 3 GHz / গিগাহার্জ)
এগুলোর মধ্যে ২,৩ হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড যা ওয়াকিটকির যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করে থাকে অধিকাংশ ব্যবহারকারী।
১। HF (High Frequency)
HF ফ্রিকোয়েন্সি ৩ মেগাহার্জ থেকে ৩০ মেগাহার্জ যোগাযোগ সম্ভব করা যায়। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি বড় হয় যার ফলে শত শত মাইল দূরেও যোগাযোগ সম্ভব। এমনকি পুরো বাংলাদেশের যেকোন জায়গায় যোগাযোগ সম্ভব। যোগাযোগের জন্য অনেক উঁচুতে এন্টিনা স্থাপনের প্রয়োজন হয় না। নয়েজ অনেক বেশি থাকে অর্থাৎ ব্যাক্তির কথাসহ আশেপাশ থেকে এত আওয়াজ আসে যে, ব্যাক্তির কথা বুঝতে অসুবিধা হয়ে। ট্রান্সমিটার/ওয়াকিটকি অ্যান্টেনা অনেক লম্বা হতে হয়। HF ফ্রিকোয়েন্সির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও শুনতে পায়। যার ফলে গোপনীয়তা নষ্ট হয়, এজন্য এই ফ্রিকোয়েন্সি তেমন জনপ্রিয় না। সেজন্য প্রয়োজন ছাড়া এই ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ কম হয়।
২। VHF (Very High Frequency)
VHF ফ্রিকোয়েন্সি ৩০ মেগাহার্টজ (MHz) থেকে ৩০০ মেগাহার্টজ (MHz) পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এটি সাধারণত অনেক বেশি দূরত্বে ভালো কাজ করে, তবে পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা (যেমন পাহাড়, বড় ভবন) থাকতে পারে, যা সিগন্যাল ব্লক করে ফেলতে পারে যার ফলে দূরত্ব কমে আসবে বা ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যাল বাঁধার সম্মুখীন হবে।VHF সাধারণত খোলামেলা স্থান, সমুদ্র বা উন্মুক্ত এলাকায় বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে। কোনো রকম বাঁধা ছাড়াই উন্মুক্ত পরিবেশে ওয়াকিটকি দিয়ে কথা চালিয়ে যাওয়া যায়।
৩। UHF (Ultra High Frequency)
UHF ফ্রিকোয়েন্সি ৩০০ মেগাহার্টজ (MHz) থেকে ৩ গিগাহার্টজ (GHz) পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এটি VHF-এর চেয়ে কম দূরত্বে সেরা কাজ করে, তবে দেয়াল, ভবন এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা ঢুকতে সক্ষম। অর্থাৎ দেয়াল,ভবন,পাহাড়, জঙ্গল যাই থাকুক না কেন UHF ফ্রিকোয়েন্সি কম দূরত্বের হওয়ায় অনেক শক্তিশালী হয় ফলে এই ধরনের বাঁধা থাকলেও কোনো সমস্যা হয় না। তাই এটি শহরাঞ্চলে বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খুব ভালো কাজ করে।
UHF অনেক বেশি সিগন্যালের ক্ষমতা প্রদান করে এবং ভালো ফলাফল প্রকাশ করে। এজন্য এই ফ্রিকোয়েন্সি বেশ জনপ্রিয় বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে এই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার দেখা যায়।
ওয়াকিটকি ব্যবহারের পদ্ধতিঃ
১। অপারেশন এবং টক বাটন (Push-to-Talk):
ওয়াকিটকি সাধারণত একটি টক বাটন (Push-to-Talk) ব্যবহার করে কাজ করে। কথা শুরু করার জন্য ব্যবহারকারী টক বাটনটি চাপেন এবং কথা শেষ হলে ছেড়ে দেন। আপনি যখন বাটনটি চেপে ধরেন, তখন আপনার আওয়াজ রেডিও সিগন্যাল হিসেবে যে ফ্রিকোয়েন্সিতে চ্যানেল যুক্ত করেছেন, সেই একই ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত থাকা অন্য ওয়াকিটকি ডিভাইসে পাঠানো হয়। আর যখন কথা শেষ হলে বাটন ছেড়ে দেন, তখন অন্য প্রান্তের ব্যক্তি কথা বলতে পারেন। একই সাথে মোবাইলের মতো দুই প্রান্ত থেকে কথা বলা যায় না। তবে অত্যাধুনিক ওয়াকিটকিতে বিশেষ সুবিধা থাকতে পারে।
২। চ্যানেল নির্বাচনঃ
চ্যানেল হলো একটি নির্দিষ্ট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি, যেখানে দুটি বা তার বেশি ডিভাইস একই ফ্রিকোয়েন্সিতে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
অর্থাৎ চ্যানেল নির্দিষ্ট করতে ওয়াকিটকি ডিভাইসের “চ্যানেল ডায়াল” বা “ডিজিটাল প্যাড” ব্যবহার করতে হবে। (1,2,3,4,5.... সংখ্যার যে বোতামগুলো থাকে।)
অনেক ওয়াকিটকি ডিভাইসে “ফিক্সড চ্যানেল” (নির্ধারিত চ্যানেল) থাকে (যেমন CTCSS বা DCS)। অর্থাৎ এগুলোকে একটি নির্দিষ্ট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে সেট করা যাবে। তবে কিছু আধুনিক মডেল “ডিজিটাল চ্যানেল সিস্টেম” ব্যবহার করে, যাতে অনেকগুলো চ্যানেল নির্বাচন করা যায় এবং নিরাপদ হয়।
৩। অডিও ইনপুট এবং আউটপুটঃ
সাধারণত বেশিরভাগ ওয়াকিটকি ডিভাইসে “মাইক্রোফোন” থাকে, যার মাধ্যমে আপনার আওয়াজ পাঠানো হয়, এবং “স্পিকার” থাকে, যার মাধ্যমে আপনি অন্যের কথা শোনেন।
তবে বর্তমানে কিছু আধুনিক ওয়াকিটকিতে “হেডসেট” এবং “ইয়ারপিস” থাকে। (কানে লাগানো যায় ইয়ারফোনের মতো।) যাতে ব্যবহারকারী হাতে বা পকেটে ওয়াকিটকি ডিভাইসটি রেখে নিঃশব্দে শুধু নিজে কথা বলতে পারে এবং শুনতে পারে।
৪। অ্যান্টেনাঃ
ওয়াকিটকি ডিভাইসে একটি অ্যান্টেনা থাকে, যা সিগন্যাল প্রেরণ এবং গ্রহণে সাহায্য করে। কিছু মডেলে ফোল্ডেবল অ্যান্টেনা থাকে। অর্থাৎ অ্যান্টেনা বড় এবং ছোট করা যায় ফলে বহন করার সময় অ্যান্টেনা ছোট করে রাখা যায়। এবং কথা বলার সময় কোনো বাঁধা ছাড়া সিগন্যাল রিসিভের জন্য বেশ কাজের। উন্নত মডেলগুলিতে “অ্যান্টেনা রেঞ্জ” বাড়ানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
৫। ভলিউম কন্ট্রোলঃ
সবধরনের ওয়াকিটকিতে ভলিউম কন্ট্রোল বাটন বা চাকার মতো ঘুরানো যায় এমন থাকে, যার মাধ্যমে আপনি শব্দ বাড়াতে বা কমাতে পারেন।
৬। ব্যাটারি এবং চার্জিংঃ
ওয়াকিটকি সাধারণত রিচার্জেবল ব্যাটারি ব্যবহার করে। বেশিরভাগ মডেল “লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি” ব্যবহার করে, যা অনেক সময় ধরে চার্জ থাকে।
কিছু মডেলে “ব্যাটারি লাইফ” ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে, তবে এটি ব্যবহারের উপর এবং ভলিউম বাড়ানো/কমানো উপর নির্ভর করে। ব্যাটারি চার্জ করতে সাধারণত একটি USB চার্জিং পোর্ট অথবা চার্জিং ডক ব্যবহার করা হয়ে
৭। রেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতাঃ
সাধারণত, ওয়াকিটকি ১-৫ কিলোমিটার রেঞ্জে কাজ করে, তবে এটি পরিবেশের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। যেমনঃ শহরের মধ্যে, বড় বিল্ডিং এবং অন্যান্য অবকাঠামো সিগন্যাল ব্লক করতে পারে, ফলে রেঞ্জ কম হতে পারে।
উন্মুক্ত পরিবেশে বা অল্প বাঁধা থাকলে, ওয়াকিটকি অনেক বড় রেঞ্জ (১০ কিলোমিটার বা তারও বেশি) পর্যন্ত যোগাযোগ করতে সক্ষম। কিছু ওয়াকিটকির বাড়তি রেঞ্জ মডেলও থাকে, যা দুরবর্তী অঞ্চলে ব্যবহার করা যায়। তবে HF (High Frequency) ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে এক দেশ ছাড়িয়ে অন্য দেশেও যোগাযোগ সম্ভব। HF নিয়ে উপরে আলোচনা হয়েছে।
ওয়াকিটকির উপকারিতাঃ
১। মোবাইল নেটওয়ার্কের প্রয়োজন নেইঃ
ওয়াকিটকি মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে বা যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল, সেখানে কার্যকরী।
২। দ্রুত এবং সহজ যোগাযোগঃ
এটি ব্যবহারকারীকে দ্রুত এবং সহজভাবে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে। বিশেষত অজানা বা বিপদজনক পরিস্থিতিতে এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
৩। দূরবর্তী অবস্থানে ব্যবহারযোগ্যঃ
ক্যাম্পিং, ট্রেকিং, সমুদ্রযাত্রা, বিভিন্ন অপারেশন এবং অন্যান্য দূরবর্তী অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য এটি উত্তম মাধ্যম হতে পারে।
৪। একাধিক ব্যবহারকারীঃ
একাধিক ব্যবহারকারী একসাথে, একযোগে একটি চ্যানেলে সংযোগ হয়ে কথা বলতে পারে, যা গোষ্ঠী কমিউনিকেশ( Group Communication) বলা হয়ে থাকে। অনেকটা গ্ৰুপ কল এ একাধিক বন্ধুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার মতো। এটা ভিডিও আর ওয়াকিটকিরটা অডিও।
৫। দ্রুত এবং সহজ যোগাযোগঃ
একে অপরের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করতে পারে, বিশেষ করে বিপদজনক বা দুর্গম এলাকায়। এবং দূরবর্তী স্থানে ব্যবহারযোগ্য এমন স্থান যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কের সিগন্যাল কম থাকে, সেখানে ওয়াকিটকি ব্যবহার করা যায়।
সতর্কবার্তাঃ
ওয়াকিটকি (Walkie Talkie) সাধারণত এটি লোকেশন ট্র্যাকিং করার জন্যে বানানো হয় নাই। তবে, যদি ওয়াকিটকি একটি GPS ফিচারযুক্ত মডেল হয় বা কোনো স্মার্টফোন বা অ্যাপের সাথে সংযুক্ত থাকে, তাহলে তা লোকেশন ট্র্যাকিং করতে সক্ষম হতে পারে।
এছাড়া, যদি কোনও বিশেষ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহৃত হয়, তবে তা দিয়ে সিগন্যালের উৎসের অবস্থান ট্র্যাক করা যেতে পারে। তবে, সাধারণ ওয়াকিটকি যেগুলি শুধুমাত্র সরাসরি যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেগুলির মাধ্যমে লোকেশন ট্র্যাকিং সম্ভব নয়।
তারপরও সাবধানতার জন্য ওয়াকিটকির পাওয়ার বন্ধ রাখা যেতে পারে বা ব্যাটারি খুলে রাখতে হবে। যখন প্রয়োজন হবে যোগাযোগের তখন চালু করে নিতে হবে। সেজন্য নির্দিষ্ট একটা সময় নির্ধারণ করে রাখা যেতে পারে অন্য প্রান্তের ব্যক্তির সাথে।
লিখেছেনঃ নাসিম আহমাদ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন