সিরিয়া বিপ্লবের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ | পর্ব ৩

 

সিরিয়ান জিহাদে আল-কায়দা এবং তুর্কির নীতিঃ
সিরিয়ান জিহাদের আল-কায়দা এবং তুর্কির নীতিটা বলার চেষ্টা করি। সিরিয়া এবং তুর্কির বর্ডার হচ্ছে কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চল। কুর্দি জাতীয়তাবাদীরা আবার আমরিকা-রাশিয়া সমর্থিত। তুর্কির জন্য তারা বড় থ্রেট, কারণ এরা স্বাধীন রাষ্ট্র চায়। তো এই ক্ষেত্রে তুর্কি আমরিকা-রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে প্রক্সি ব্যাবহারের চেষ্টা করে।

[কুর্দি অঞ্চল ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কজুড়ে বিস্তৃত ভূমি। কুর্দি কারা?  https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kurds


শুরুতে আইসিস কুর্দী জাতিয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ে তুর্কীকে সুবিধা দিচ্ছিল। পরবর্তীতে, সুন্নী বিপ্লবীদের তুর্কীপন্থী অংশটা বাশার আল-আসাদকে ফেলে কুর্দিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তুর্কির প্রক্সি হিসেবে।

এই অঞ্চলটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনেক তেল ক্ষেত্র আছে। তুর্কি চেষ্টা করে এসবের মাধ্যমে আমরিকা-রাশিয়ার বোঝাপড়ার টেবিলে নিজেদের স্বার্থটা উদ্ধার করতে। সিরিয়ার মানুষের স্বার্থ তার জন্য সেকেন্ডারি ইস্যু। এই যে আলেপ্পো বা হালব জয় হলো, এটা বিপ্লবীদের'ই থাকতো, যদি তুর্কি তখন এন্টি এয়ার ক্রাফট মিসাইল দিত। কিন্তু তারা দেয় নি। তারা ততটুকু সমর্থন করে না, যতটুকু করলে বিপ্লবীরা জিতে যায়। আবার একেবারে সরিয়েও নেয় না, যতটুকু নিলে বিপ্লবীরা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। এখন দেখেন সামনে কি হয়!

কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে দেখেন, ইরান তাদের জান-প্রাণ দিয়ে দিচ্ছে গত ১২ বছর ধরে বাশার আল-আসাদকে টিকানোর জন্য। তাদের অর্থনীতি বাজি লাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ফালিস্তিনের ক্ষেত্রে তারা প্রক্সি লড়ে, অথচ সিরিয়াতে তাদের সেনারা এসে লড়াই করে। এমনেই পাক-আফগান থেকেও শিয়াদের নিয়ে এসেছে সিরিয়াতে লড়াই করার জন্য। যদি শিয়ারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, তোমরা আলেপ্পো জয় করছো, গাযযা কেনো পারছো না? তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন তোমারা তো দামাস্কাসে বসে আছো, আল-কুদসে যেতে কেনো পারছো না, গোলান হাইট তো তোমাদের বর্ডারেই - তোমাদের যুক্তি তো তোমাদের জন্য বেশী প্রযোজ্য। শিয়ারা কেবল মূ্র্খ লোকজনকেই প্রতারিত করতে পারবে, আর তারা নিজেরাও মূর্খ!

আল-কায়দার নীতিটা হলো যে, আল-কায়দা এ যুদ্ধ শুরু করে নি। আল-কায়দা এভাবে গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে না। আল-কায়দা এমনকি শিয়া-রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধের পক্ষে না, যদি না তারা আগে আগ্রাসন চালায়। তখন অবশ্যই রিটালিয়েট করতে হবে। সিরিয়াতে সেটাই হয়েছে আল-কায়দা আগ্রাসী শিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে।

এখানে আল-কায়দার সাথে তুর্কির মতপার্থক্য হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে আল-কায়দার মত পার্থক্যের মত। আফগানের আল-কায়দা অলমোস্ট রেডিমেইড তালিবানিদের পেয়েছিল। কিন্তু সিরিয়াতে তালিবানদের মত একক চেইন অব কমান্ডের কোন স্থানীয় দল নেই। তো শুরুতে আল-কায়দার প্ল্যান ছিল, নীরবে তালিবদের মত একটা ফ্রন্ট তৈরী করা - যেটার স্থানীয় সমর্থন থাকবে। পরবর্তীতে যারা একটা ইমারাত তৈরী করবে।

পাকিস্তান এবং তুর্কি উভয় চেষ্টা করে যে, তাদের প্রক্সি ব্যবহার করে কোনো স্বার্থ হাসিল করা - যেটা আবার আল-কায়দার স্বার্থ বিরোধী। যদিও তালিবানদের ক্ষেত্রে পাকিস্তান আল-কায়দার কাছে হেরে গিয়েছে। তালিবানরা পাকিস্তানের কথা না শুনে মূলত আল-কায়দার কথাই শুনেছে - কারণ তালিবানরা আসলে রেডি ছিল শোনার জন্য। কিন্তু সিরিয়ার বিপ্লবীরা আল-কায়দার কথা ঠিক মত শুনে নি। এদিকে তুর্কিও রেবেলদের এমনভাবে দেখে রাখতো যেন তারা আল-কায়দার কথা না শুনে এবং সম্পর্কচ্ছেদ করতে বাধ্য হয়।

একবার তো তুর্কি রাশিয়ার সাথে কি একটা চুক্তি প্রায় করেই ফেলছিল যেটা সিরিয়ার সুন্নীদের স্বার্থ বিরোধী। তখন প্রেস কনফারেন্সে রাশিয়ার দূতকে মেরে ফেলা হয়। সবাই বলাবলি করতে থাকে যে, ইসলামে দূত হত্যা নিষিদ্ধ। কিন্তু সেটা না করলে তো রাশিয়া-তুর্কির সম্পর্ক নষ্ট করা যেত না। হয়ত চুক্তিটা হয়েই যেত।
Russian Ambassador to Turkey Shot Dead in Ankara 



সবাই দোষারোপ করলো আল-কায়দা এসব করে আসলে কি মজা পায়? ইসলাম বিরোধী কাজ! অথচ ওই দূত তো আল-কায়দার কাছে রাশিয়ার দূত ছিল না! এটা জাস্ট একটা উদাহরণ যে, তুর্কি-আল-কায়দা উভয়ই তাদের সফট পাওয়ার ইউস করেছে নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্য বিপ্লবীদের উপর। কিন্তু তুর্কি তাদের স্টেট পাওয়ারের কারণে আল-কায়দাকে দামিয়ে রাখতে পেরেছে এবং বিপ্লবীদের নিজেদের পক্ষে নিয়ে। যেমনটা পাকিস্তান তালিবানদেরকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আল-কায়দাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। হয়তো আফগানের সমীকরণটা অনেক সরল ছিল, যেটা সিরিয়ার ক্ষেত্রে খুবই কম্প্লিকেটেড (জটিল)।
 
সিরিয়া এমন একটা জায়গা যেখানে আমরিকা-রাশিয়া, শিয়া-সুন্নী, গ্লোবাল-লোকাল, ইজরায়েল ইস্যু, ডেমোক্রেসি-শরীয়াহ সব কনফ্লিক্ট একইসাথে আছে।

আল-কায়দা যখন নিভৃতে সিরিয়াতে তালিবদের মত ফ্রন্ট গঠনে ব্যস্ত ছিল, ঠিক তখন ইরাক থেকে বাগদাদী এসে সেটাকে ওপেন একটা প্রোজেক্ট হিসেবে ঘোষণা দিল যে সব বিপ্লবীকে তার অনুগত হতে হবে। যেটা পুরোপুরি বাস্তবতা এবং রাজনীতি বিবর্জিত ছিল। মানুষজন অটো একটা চেইন অব কমান্ডে এসে পড়তো যদি হৃদয়গুলো এক করা যেত। এক চেইন না থাকলেও, জোট করলে সেটাতে আস্থা থাকতো। কারণ তুর্কি ছাড়াও তখন কাতার, সৌদী, আমিরাত এগুলো সমর্থক হিসেবে ছিল। আরব আমিরাত সাইড চেইঞ্জ করে এখন আসাদের পক্ষে। সৌদী চুপ। আর কাতার সম্ভবত তুর্কির পক্ষে আছে। কিন্তু শুরুতে আইসিস এবং পরবর্তীতে তুর্কির কারণে আল-কায়দা সিরিয়াতে নিজেদের প্ল্যানগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে নি।

একদিকে আইসিস খুঁজে খুঁজে আল-কায়দার টপ লিডারদের মারছিল, যাদের আমরিকাও অনেক চেষ্টা করে মারতে পারে নি। আরেকদিকে আমরিকা তু্র্কির এয়ার বেইস থেকে উড়ে এসে আল-কায়দার লীডারদের খুঁজে খুঁজে মেরে একেবারে লীডার শূণ্য করে দিচ্ছিল। রেবেলদের (বিপ্লবী) অনেকে বললো যে, আমরিকার এয়ারস্ট্রাইক থেকে বাঁচতে হলেও অন্তত আল-কায়দার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। কিন্তু ওইদিকে আবার রাশিয়ার এয়ারস্ট্রাইকও আছে। এসব নিয়ে রেবেলদের মধ্যে আল-কায়দাপন্থী এবং আল-কায়দাবিরোধীদের বিতর্ক আজো চলমান।

লিখেছেনঃ Bearded Bengali

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন