কুর্দি কারা? সব কুর্দি কি খারাপ?
উপরের ছবিটা আলান কুর্দির। যুদ্ধের কারণে রিফিউজি হিসেবে তুর্কি থেকে ইউরোপ যাওয়ার সময় এই ঘটনাটা ঘটে।
কুর্দি হলো একটা জাতির নাম। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর জাতির নাম কুর্দি। ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মায়ের ব্যাপারেও বলা হয়ে থাকে যে তিনি কুর্দি ছিলেন। এই জাতির বসবাস ইরাকের উত্তরে, বর্তমান তুর্কির দক্ষিণ পূর্বে, ইরান এবং সিরিয়ার কিছু অঞ্চল। বাঙলী জাতির কথা চিন্তা করতে পারেন যে অধিকাংশই বংশগত কারণে সুন্নী। কিন্তু এখন অনেক মতবাদের লোকজন আছে।
যেমন কিছু লোক স্বাধীন কুর্দিস্তান চায়। এতে হবে কি তুর্কি, ইরাক, ইরান, সিরিয়া থেকে ভালো একটা অংশ নিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হবে। এবং রাষ্ট্রটির খনিজ তেলে ভরপুর। কিন্তু আবার ল্যান্ড লক (স্থলবেষ্টিত)।
এই স্বাধীনতাকমী কুর্দিদের একটা সময় রাশিয়া সমর্থন করতো, এজন্য এরা হচ্ছে বাম-মার্কিনিষ্ট। এখন আমেরিকাও সমর্থন করে। তারাই মূলত আমেরিকান দালাল।
কিন্তু তারা আবার তুর্কির শত্রু। তুর্কিতে তারা মাঝে মধ্যে ঝামেলা করে। আবার ইরাকের কুর্দিরা সাদ্দামের আমলেই স্বায়ত্তব শাসন পেয়েছিল। ইরান-সিরিয়াতে তাদের বসবাসের অঞ্চল কম। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধের সুযোগে আমেরিকা এইসব কুর্দিদের অনেক ক্ষমতায় করেছে। দাঈশকে পরাজিত করার পর, সেই অঞ্চলগুলো তারা এই কুর্দিদের হাতেই দিয়েছে।
সব কুর্দিরাই কি খারাপ? না। ইসলামিস্ট কুর্দিও আছে। যেমন ইরাকের আনসার আল-ইসলাম।
যখন বুশ ইরাকে আক্রমণ করে, আল-কায়দা, আইএস এর সবচাইতে বড় মিত্র ছিল ইরাকে কুর্দিস্তানের আনসার আল-ইসলাম।
তারা এখন সিরিয়াতেও মুজাহিদদের সাথে লড়ছে। সিরিয়াতেও কুর্দিস্তান ইসলামিক ফ্রন্ট নামে একটা সংগঠন ছিল, সেটা পরে অবসান হয়ে যায় অন্য দলের মধ্যে। মোট কথা হলো শাহবাগী-লীগারদের মত কিছু কুর্দি আমেরিকার দালালিতে ব্যস্ত। আবার কিছু কুর্দি জান-মাল আল্লাহর জন্য কুরবান করে দিচ্ছে।
আমরিকরা SDF সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স নামে একটা ক্যামোফ্লেজ দল বানিয়েছে যেটা আসলে ওই মার্কিনিষ্ট কুর্দিদের নিয়ে গঠিত। তারা একদিকে তুর্কির শত্রু, দাঈশের শত্রু আবার মুজাহিদদেরও শত্রু। অর্থাৎ তারা খারিজী, মুর্জিয়া, এবং আহলুস সুন্নাহ সকলের শত্রু।
আবার শিয়াদের সাথে মিত্রতার থাকলেও, মাঝে মাঝে ঝামেলা হয়। প্রাণের বন্ধু না আর কি।
অথচ এরা হয়ত কোন সুন্নী ঘরেরই সন্তান। তথাকথিত স্বাধীনতা আর স্বাধীন কুর্দিস্তানের লোভ দেখিয়ে তারা আমেরিকা-রাশিয়ার ভাড়া খাটা সেনা। মরলেও শাহাদাতের আশা নেই। কারণ তারা তো সেক্যুলার।
মেয়েরাও এসে যুদ্ধ করে পরিস্থিত নাকি এত খারাপ তাদের। অথচ তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে আমেরিকানরা তেল নিয়ে যাচ্ছে, তারা সেগুলা পাহারা দিচ্ছে।
এদিকে তুর্কি আমেরিকারে ডিরেক্ট কিছু বলতে না পারলেও এদের পিটিয়ে আমেরিকারে শিক্ষা দেয়ার চিন্তা করে। অথচ আমেরিকা যখন দাঈশ পিটাইতে ছিল, তখন তুর্কির চুপ করে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না।
জেনে অবাক হবেন যে, দাঈশ শক্তিশালী হবার পর তুর্কি লাভবান হচ্ছিল। কারণ দাঈশ ওই বাম কুর্দিদের সাইজ দিচ্ছিল, এতে তুর্কি বর্ডার সেইফ হচ্ছিল।
আর দাঈশ ব্ল্যাক মার্কেটে তেল কিছুটা কমে ছেড়ে দিচ্ছিল, এতেও তুর্কি অনেক লাভবান হচ্ছিল। অথচ আমেরিকা এসে দাঈশকে হঠিয়ে ওই জায়গাটাতে কুর্দিদের বসালো।
দেখেন আমরা খারিজী, মুর্জিয়া, আহলুস সুন্নাহ আমাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি থাকলেও - আমরা একে অপরের দ্বারা লাভবান হই অনেক ক্ষেত্রেই এখানেও শিয়ারা এসে পড়লে ঝামেলা। আর ডিরেক্ট কাফির, মুশরিকার এসে পড়লে তো আমাদের আমও গেলো-ছালাও গেলো।
HTS এর সাথে আল-কায়দার মতবিরোধের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ
হায়াতু তাহরীর আশ-শাম (HTS)-এর সাথে আল-কায়দার মত বিরোধ নিয়ে আমি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে আলোচনা করবো।
আল-কায়দার মূল থীম হলো আমেরিকান স্বার্থে আঘাত করে আমেরিকাকে দুর্বল করা। যেন কোনো বিপ্লবের পর আমেরিকা তার পুতুল বসাতে না পারে। এই জন্য জরুরী না যে, লোকালি যেসব বিপ্লব হবে সেগুলো আল-কায়দার মাধ্যমেই হতে হবে। বরং যে কোন ইসলামপন্থী গ্রুপই সেটা করতে পারে - কিন্তু আল-কায়দা চায় যে তাদের উপর আল-কায়দার ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাব বিস্তার) থাকুক।
সিরিয়ার বিপ্লবের শুরুতে আল-কায়দা ট্রাই করছিল যে, নুসরাহ সহ আহরার এবং বাকি আরো যেসব দল আছে, সবগুলোতে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে সেগুলোতে নিজেদের ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাব বিস্তার) বাড়ানো, যেন বিপ্লবের পর একটা ইসলামী ইমারত প্রতিষ্ঠায় আন্তার্জাতিক তাগুতদের সাথে আপোষ করা থেকে বিপ্লবীরা বিরত থাকে।
কিন্তু বাগদাদী এসব না বুঝে নিজের একাট সেন্ট্রাল কমান্ড তৈরী করার চেষ্টা করছিল জোর করে।
যেখানে আল-কায়দার কথা হলো কোন দল নিজ থেকে একটা চেইন অব কমান্ডে আসলে ভালো। আল-কায়দার অধীনে আসলেও ওয়েলকাম। কিন্তু না আসতে চাইলেও অন্তত একটা বোঝাপাড়া সম্পর্ক রেখে এগিয়ে চলা।
যেমন আফগান তালিবান, পাকিস্তান তালিবান, ইরাকের কুর্দি আনসার আল-ইসলাম এরকম আরো অনেক দলের সাথে আল-কায়দা মিত্রতার সম্পর্ক রেখে কাজ করে - একটা ইকো-সিস্টেমের মত ক্রিয়েট করেছে।
আল-কায়দার আরেকটা পলিসি হলো যে, সব জায়গায় নিজেদের নাম প্রকাশ না করা। মাসলাহা-মাফসাদা বুঝে কাজ করা। যদিও প্রয়োগের বেলায় বিভিন্ন সময় ব্লান্ডার হয়েছে। যেমন সিরিয়ার ক্ষেত্রে আল-কায়দার শুরুতে ইচ্ছা ছিল না যে আল-কায়দার নাম প্রকাশ পাক।
কিন্তু তখন বাগদাদী হাত থেকে বাঁচতে আল-জুলানী আল-কায়দার সাথে নিজের সম্পর্কের কথা বলে। যেন, আল-কায়দা তার পক্ষে থাকে এবং মুজাহিদরা আল-কায়দার মর্যাদার কথা চিন্তা করে আল-জুলানীর দল ত্যাগ না করে।
এই পরিচন প্রকাশ হবার পর, আমেরিকা এবং তার মিত্ররা আবার আরেকদিকে রাশিয়াও মুজাহিদের উপর নির্বিচারে হামলা করা সুযোগ পায়। এখানে গ্লোবাল এবং লোকাল জিহাদের একটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দেখা দেয় যে, আমেরিকা এবং এর মিত্রদের এস্যাসেট গুলোকে হুমকি না দিলে আমেরিকা হামলা করবে না।
কিন্তু আল-কায়দার সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখলে আমেরিকা আর তার মিত্রতা তাদের সেইফ এক্সিট দিবে না। তো বাশারের পতনের জন্য আমেরিকার সাথে সরাসরি সংঘর্ষ না গিয়ে ওই চ্যাপ্টারে একটা পজ দেয়ার জন্য আল-জুলানি আল-কায়দার ইকোসিস্টেমে তিনি আর নেই বলে ঘোষণা দেন।
কিন্তু আল-কায়দা বিষয়টাতে সন্তুষ্ট না হলোও, যেহেতু তার একটা ভ্যালিড যুক্তি ছিল, তাই প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল থেকে কিছু বলেনি।
এর আগে ইরাকের আল-কায়দা-ও কিছুটা সেইম কাজ করেছিল, গেরিলা যুদ্ধের মাঝখানে নিজেদের স্টেট ঘোষণার মাধ্যমে, যা আল্টিমেটলি আল-কায়দা এবং ইরাকের জিহাদের চরম ক্ষতি করেছিল।
আল-কায়দা চুপ থাকলেও, আল-কায়দা লিংকড লোকাল গ্রুপগুলো আল-জুলানীর উপর বিরক্ত হচ্ছিল, কারণ তুর্কির প্রতি তিনি খুব বেশী ডিপেন্ডেন্ট (নির্ভরশীল) হয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ তুর্কির মধ্য দিয়ে জনগণের লজিস্টিক (যুদ্ধের গোলা বারুদ,রসদ) সাপোর্ট আসে।
তুর্কি এগুলো বন্ধ করে দিলে জনগণ বিদ্রোহ করবে। ওইদিকে বাশার বাহিনী আবারো স্ট্যাবল (সুস্থিত/স্থায়ী) হয়ে যাচ্ছিল, আল-জুলানী নিজেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছিলেন না। এমনকি যারা চালাতে চায়, তাদের এক হাত নিচ্ছিলেন, তাদের বন্দী করছিলেন।
হামাসের ব্যাপারেও সেইম অভিযোগ ছিল যে, তারা নিজেরাও জায়োনিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযান না চালিয়ে, ইরান সহ বাকিদের ডিপ্লোমেসীর (কূটনীতি)-র উপর ভর করে ছিল।
এবং যারা হামাসের কথা না শুনে নিজেরা নিজেরা আলাদা দল করে, জায়োনিষ্টদের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাচ্ছিল, তাদের দমন করছিল।
যেমন ইবনু তাইমিয়াহ মসজিদের ইনসিডেন্টটা। তো জুলুমের পর, আল-কায়দাও হামাসকে বিব্রত করার চেষ্টা করেনি। আর তাহরীরকেও আল-কায়দা বিব্রত করতে চায় না নিজেদের ব্যানার তুলে, ঠিক যেভাবে তালিবানদেরও সেটা হোক পাক কিংবা আফগানের তাদের বিব্রত করতে চায় না, নিজেদের উপস্থিতি ক্লেইম করে। তারা শুধু চায় শরীয়াহ কায়েম হোক, এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে সঠিক উপায়ে অভিযান চালানো হোক।
তাই হামাস কিংবা তাহরীর যেই মুসলিমদের বিজয়ে কাজ করবে, শরীয়াহ কায়েম করবে, আল-কায়দা তাদের পক্ষে। যদিও তাদের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা, সংশোধনের উপদেশ দেক না কেন। কারণ আল-কায়দা আল্টিমেট টার্গেট কিন্তু নিজেরা আমীর কিংবা সুলতান হওয়া নয়, বরং মুসলিম জনগণের পছন্দে, আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের পছন্দে আমীর নিয়োগ হবে, ইমারাহ প্রতিষ্ঠা হবে। শরীয়াহ কায়েম হবে।
এরকম একাধিক ইমারাহ প্রতিষ্ঠা হতে থাকলে নিজেরা নিজেরা শূরা করে ফেডারেশন তৈরী করবে। হয়ত একটা সময় তারা যথেষ্ঠ শক্তিশালী হলে একজন খলিফা নিয়োগ দিবে, যার খিলাফতকে সমগ্র উম্মাহ বরণ করেনিবে। এটাই গ্লোবাল জিহাদ!
তো সিরিয়াতে মুজাহিদদের বিজয় মানে আল-কায়দারই বিজয়, কারণ তারা এটা চায়, যেই করবে তাদের স্বাগত জানাতে হবে। এবং যা যা প্রয়োগ হচ্ছে মাঠে, এগুলো আল-কায়দা আরো ২০-২৫ বছর আগে লিখে গিয়েছে।
আপনার আবু মুসআব আস-সুরীর “দাওয়াতুল মুকাওয়ামা” পড়ুন, এবং জেনারেল আল-আদিলের লেখাগুলো পড়ুন। দেখবেন যে তালিবানরা সেটা প্রয়োগ করেছে, তাহরীরও প্রয়োগ করছে।
হামাসও কম বেশি প্রয়োগ করেছে যে কিভাবে অরাজকতার ব্যবস্থাপনা করতে হয়। প্রয়োগ করেনি কেবল দাঈশ। তারা ডিপ্লোমেসীকে (কূটনীতি) অস্বীকার করেছে।
এখন সিরিয়াতে রাজনীতির মাঠে মুজাহিদদের জিততে পারে কিনা দেখার বিষয়। তারা কি আন্তর্জাতিক তাগুতদের হারিয়ে তালিবানদের মত ইমারাহ করতে পারে কিনা।
কারণ আল-কায়দার মেইন গ্লোবাল জিহাদ তো এটাই যে সাপের মাথা আমেরিকার ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাব) যেন এতটা কমে যায়। বিপ্লবের পর যেন তা ছিনতাই না করে এনজিও সরকার, পুতুল সরকার, তাদের দিক্ষায় দিক্ষিত সরকার এবং সিস্টেম বসিয়ে দিতে না পরে।
লিখেছেনঃ Bearded Bengali
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন